প্রাচীনকাল থেকে রোগ-ব্যাধির সঙ্গে মানুষের বসবাস। নানা অসুখবিসুখের সঙ্গে লড়াই করে মানবসভ্যতা টিকে আছে। কিন্তু তারপরও যুগে যুগে এমন কিছু রোগ এসেছে যাদের সামনে টিকতে না পেরে হুমকির মুখে পড়েছে বহু জাতি। বিশ্বকে পক্ষাঘাতের রোগীর মতো অচল করে দিয়েছে কখনো কখনো। পৃথিবী ভুলতে পারবে না কোনোদিন সেইসব ঘাতক মহামারির নাম। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, তাগড়া যুবক কাউকেই রেহাই দেয়নি। বাছ-বিছার করেনি রক্ত-বর্ণ, ধনী-নির্ধনের। বহু রাজা-উজির, সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী টলে গেছে সেইসব কালোমৃত্যুর ছোবলে।
ইতিহাস বলে রোমান ও বাইজেন্টাইনের মতো প্রবল শক্তিধর সাম্রাজ্যের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল প্লেগ নামের বিভৎস ও ভয়ঙ্কর এক অসুখ। মহামারি শ্রেণিনিরপেক্ষ। দেশ-কাল বুঝে না। এশিয়া-ইউরোপ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য কাউকে ছাড়েনি। এই করোনাকালে বসে মহামারি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা কিছুটা আন্দাজ করা সহজ আমাদের জন্য। কিন্তু ইতিহাসের বইয়ে লেখা রয়েছে বর্তমান বৈশি^ক মহামারির চেয়েও নির্দয় বহু ব্যাধির নাম। এ পাঠ জরুরি ধরে নিয়ে ফিরে তাকানো যাক আরববিশ্বের দিকে।
আরব্য দেব-দেবীর ক্রোধ ও বদ জিনের খেলা
প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই আরবের মানুষ রোগ-ব্যাধিকে সঙ্গে করে টিকে আছে। নানা সময় মরণঘাতি নানা অসুখ আক্রমণ করেছে, আরবরাও নিজেদেরকে রক্ষা করার মতো প্রতিরোধী ব্যবস্থা নিয়েছে। রোগকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে আখ্যান, বিশ্বাস। প্রাচীন আরবরা মনে করতো মহামারি দেব-দেবীদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। এ জন্য দেব-দেবীদের সন্তুষ্ট করা ছাড়া রেহাই নেই। কখনো বা মনে করতো মহামারি মূলত মানুষকে নিয়ে বদ জিনের নিষ্ঠুর খেলা। নিজেদের রোগের হাত থেকে বাঁচানো জন্য জিনকে তাড়াতে নানা রকম কাজ করতো তারা।
বিখ্যাত আরব কথাসাহিত্যিক জুরজি জায়দান তার ‘তারিখ আল-তামাদ্দুন আল-ইসলাম’ (ইসলামি সভ্যতার ইতিহাস) গ্রন্থে লিখেছেন,’ইসলামের আগমনের আগে আরবরা মহামারির আশঙ্কা দেখা দিলে গাধার সুরে চিৎকার করতো। তাদের বিশ্বাস এই বিকট চিৎকার মহামারির হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করবে।’
মহামারিকে কেন্দ্র করে ইসলামপূর্ব আরবদের মাঝে আরো নানা ধরনের সংস্কার চালু ছিল। আরবরা মনে করতো মহামারি ছড়িয়ে দেওয়া ‘খারাপ আত্মা’দের কাজ। এ জন্য ওরা নানা তাবিজ-কবজ ব্যবহার করতো। বিভিন্ন প্রাণীর হাড়, চোখ, পা, ঘোড়ারখুঁড় দেয়ালেও চৌকাঠে টাঙিয়ে রাখতো। বিশ্বাস করতো এসব তাদের বদদৃষ্টি থেকে রক্ষা করবে।
ইসলামপূর্ব আরবের এ বিশ্বাসের সঙ্গে নবি মুহাম্মদ সা.এর আগমনের পরবর্তী আরবের চিন্তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নবি মুহাম্মদ সা. মহামারিকে আল্লাহ প্রদত্ত একটি রোগ বলে ঘোষণা করেন। মহামারি দেখা দিলে প্রত্যেককে স্ব স্ব স্থানে অবস্থানের নির্দেশ দেন।
আরবে ছোট-বড় বহু মহামারি ছড়িয়েছে। এই নিবন্ধে তার কয়েকটিমাত্র উল্লেখ করার সুযোগ আছে। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আরবভূমির মহামারির দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক।
মিশরে মহামারি
প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিশর প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই নানা ঘটনার সাক্ষী। বহু রোগ-বালাই বারবার আঘাত করেছে দেশটিতে। হাজার হাজার বছর আগে দুনিয়া শাসনকরা ফারাওদের মমিতে পাওয়া গেছে গুটি বসন্তের দাগ। এ থেকে গবেষকরা মনে করেন, মিশরে ফারাওদের ডোবার পেছনে রয়েছে গুটি বসন্তের মতো মহামারির প্রভাব। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে লিবিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর ও গ্রিসে ছড়িয়ে পড়ে একটি মহামারি। টাইফয়েড জ্বরের এই মহামারিতে ওই অঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়।
২৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় তিন শ বছর উত্তর আফ্রিকা, রোম ও মিশরে গেঁড়ে বসেছিল সাইপ্রিয়ান প্লেগ। বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী এ মহামারিটি রাজপরিবার ও রোমান সাম্রাজ্যকে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল। এ মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা প্রথম ব্যক্তি ছিলেন চার্চের একজন যাজক। তার নামানুসারেই প্লেগের নাম হয় সাইপ্রিয়ান প্লেগ।
৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে মিশর থেকেই প্রথম ছড়িয়ে পড়ে জাস্টিনিয়ান প্লেগ নামের মানব বিধ্বংসী একটি মহামারি। সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নামানুসারে এ রোগের নাম হয় জাস্টিনিয়ান প্লেগ। মিশর থেকে ফিলিস্তিন, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এ মহামারি। কেড়ে নেয় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ মানুষের জীবন কেড়ে নেয় ইঁদুরবাহি এ রোগ।
তাউন আমওয়াস—সাহাবি হত্যাকারী নির্দয় ঘাতক
আরবি ‘তাউন’ অর্থ প্লেগ। ‘আমওয়াস’ প্যালেস্টাইনের আল-কুদস ও রামাল্লার মধ্যবর্তী একটি জায়গার নাম। এখান থেকেই এই মহামারিটির সূত্রপাত। আমওয়াস থেকে এটি শামে (সিরিয়ায়) ছড়িয়ে পড়ে।
৬৪০ খ্রিষ্টাব্দ। জেরুসালেম বিজয়ের দ্বিতীয় বছর। মুসলিম বিশ্বের শাসনক্ষমতায় রয়েছেন নবি মুহাম্মদের সতীর্থ খলিফা ওমর। শামের উদ্দেশে বের হয়েছেন খলিফা। হেজাজ ও শামের মাঝামাঝি একটা অঞ্চলে থামেন খলিফা ওমর। এ সময় খবর আসে শামে মহামারি দেখা দিয়েছে। খলিফা নবির বাণী—’মহামারি আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করবে না’ স্মরণ করে শামে না গিয়ে ফেরত আসেন এবং শামের গভর্নর আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহকেও মদিনায় আসার নির্দেশ দেন। আবু উবায়দা তার সেনাবাহিনী ও জনগণকে ছেড়ে মদিনায় যেতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত এ মহামারিতে শামের বিশ হাজার বাসিন্দার সঙ্গে তারও মৃত্যু হয়।
আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ ছাড়াও এ মহামারিতে আরো কয়েকজন বিখ্যাত সাহাবি ইনতেকাল করেন। মুয়াজ বিন জাবাল, ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান, হারিস বিন হিশাম, সুহাইল বিন আমর, উতবাহ বিন সুহাইল প্রমুখ সাহাবির মৃত্যুর কারণে এ মহামারিটি ইতিহাসে সাহাবিহন্তারক মহামারি হিসেবে পরিচিত।
নীল নদের তীর থেকে আরববিশ্বে আল-মাউত আল-আসওয়াদ বা কালো মৃত্যুর ঢেউ
এশিয়া থেকে সারা দুনিয়ায় তাণ্ডব চালানো ভয়ঙ্কর মহামারিটি ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত। ১৩৪৬ সাল থেকে ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই যমদূত। আরব অঞ্চলে এই কালো মৃত্যু ‘আল-মাউত আল-আসওয়াদ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। চীনে মোঙ্গলদের জয় হলে চাষবাস ও কলকারখানায় অনুৎপাদনশীলতার সৃষ্টি হয়। ব্যাপক খাদ্যঘাটতি থেকে মন্দার তৈরি হয়। ব্ল্যাক ডেথে আক্রান্ত হয় মোঙ্গলরাও। কোথাও কোথাও মোঙ্গলরা মহামারিতে আক্রান্ত সেনাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। আক্রমণ করা এলাকায় সেনাদের লাশ ফেলে মহামারি ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। এতে মানুষ ঘরবাড়ি-শহর ছেড়ে পালাতে থাকে। ব্যবসায়ীরা জাহাজে করে শহরত্যাগ করতে থাকে। আর এভাবেই বন্দরে বন্দরে পৌঁছে যায় বিশ্বের কুখ্যাত মহামারি ব্ল্যাক ডেথ। বণিকদের জাহাজে থাকা কালো ইঁদুর যাত্রীদের মাঝে বুবোনিক প্লেগ ছড়িয়ে দেয়। এশিয়া থেকে সিল্করোড হয়ে এই প্লেগ পৌঁছে ক্রিমিয়ায়।
১৩৪৬ সালে বণিকদের মাধ্যমে কনস্ট্যান্টিনোপোল থেকে কৃষ্ণসাগর হয়ে একটি জাহাজ এসে নোঙর করে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। দাস ব্যবসায়ীদের সে জাহাজ থেকে সমগ্র আরববিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে আল-মাউত আল-আসওয়াদ বা ব্ল্যাক ডেথ। সে বছরই গাজা, জেরুসালেম, হোমস, দামাস্কাস, আলেপ্পোসহ প্যালেস্টাইন, লেবানন, তিউনিসিয়া ও সিরিয়ার নানা শহরে দাপিয়ে বেড়ায় এ যমদূত। ১৩৪৯ সালে পবিত্র শহর মক্কা, মসুল ও বাগদাদ আক্রান্ত হয়।
১৩৪৬ সাল থেকে ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত এ মহামারিতে ইউরেশিয়ায় ২০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। ঐতিহাসিক সূত্রমতে আল-মাউত আল-আসওয়াদের কারণে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।এ মহামারিতে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় একদিনেই বিশ হাজার মানুষ মারা যায়। ১৩৪৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৩৪৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কায়রো ও পূর্ব-মিশরের বেলবাইসে মৃত্যু হয় দুই লক্ষ মানুষের।
আরব ঐতিহাসিকদের লেখাজোখা থেকে এ মহামারির বিভৎসতার আন্দাজ করা যায়। বুবোনিক প্লেগ শহর-নগরকে এমনভাবে খালি করেছিল যে, মৃতদের লাশ দাফনের জন্যও কোনো মানুষ পাওয়া যেত না। দেখা দিয়েছিল কফিনের অভাব। লাশ বহনের জন্য খাঁটিয়া না পেয়ে মানুষ দরজার পাল্লা ব্যবহার করেছে। কাফনের অভাবে কম্বল দিয়ে কবরে শুইয়ে দিতে হয়েছে। অবশ্য অনেকের ভাগ্যে তাও মেলেনি। গণকবর ছিল একমাত্র উপায়। যাদের কপালে তাও জুটেনি তাদের লাশ রাস্তাঘাটে পড়ে থেকে পচে গলে গেছে। এতে মহামারি আরো জোরসে ছড়িয়েছে।
ইবনে বতুতার বর্ণনা
‘আল-মাউত আল-আসওয়াদ’ বিষয়ে মরোক্কান পরিব্রাজক ইবনে বতুতার একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। ইবনে বতুতা লিখেছেন,’সে সময় মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষদের দেহ পথে-ঘাটে এলোমেলো পড়েছিল। শকুনের দল আকাশে দলবদ্ধ হয়ে উড়ছিল। বড় বড় গর্ত করে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। মুসলমানরা কুরআন হাতে প্রার্থনার জন্য বেরিয়েছিল কোথাও কোথাও। আক্রান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা ‘সাওমে বিছাল’ বা তিন দিন লাগাতার রোজা রেখেছেন।’
ইবনে খালদুনের বর্ণনায় তিউনিসিয়ায় আল-মাউত আল-আসওয়াদ
বিখ্যাত আরব পন্ডিত, সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন (আবু যায়দ আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালদুন আল-হাদরামি, ১৩৩২-১৪০৬ খ্রিস্টাব্দ) সতের বছর বয়সে তিউনিসিয়ায় আল-মাউত আল-আসওয়াদ মহামারিতে তার পিতা-মাতাকে হারান। হারিয়েছেন তার অনেক শিক্ষককেও। ফলে খুব ঘনিষ্ঠভাবে এ মহামারিকে দেখেছেন তিনি।
তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-মুকাদ্দিমা’য় ১৩৪৮-১৩৪৯ সালে তিউনিসিয়ায় মহামারি ছড়িয়ে পড়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,’দেশও গোষ্ঠীগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যেন মহাবিশ্বের জিহ্বা নিস্তেজের দিকে আহ্বান করছিল। যেন এ এক নতুন সৃষ্টি। নতুন বিশ্ব!’ প্লেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন,’প্লেগের প্রধান কারণ বায়ু দূষণ, নগরায়ন, ও আর্দ্রতা।’
ইবনে খালদুন আরো লিখেছেন,’প্লেগ মহামারি ছড়িয়ে পড়া মূলত রাষ্ট্রের দুর্বলতা এবং হিজরতের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের প্রাকৃতিক ফল। মানুষ এসব কারণে কৃষিকাজ থেকে দূরে থেকেছে।’ ইবনে খালদুন আরো ব্যাখ্যা করেন,’যে শহরে সূর্যের আলো ভালো করে পড়ে না এবং নগরের বাতাস চলাচল ভালো হয় না সে শহরের নাগরিকদের ব্যক্তিত্ত্বে ও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’
ইবনে খালদুনের উপরের বর্ণনা কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট বর্তমান বিশ্বের অচলাবস্থার মূল কারণের দিকেও কি আমাদের নজর ফেরাতে বলে না?
প্লেগের মুখে ইরাক
ইরাক তার প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। বহু জ্ঞানী-গুণীর জন্ম এ মাটিতে। বিশেষ করে বাগদাদ ও বসরা নগরী এ ক্ষেত্রে অতুলনীয়। কিন্তু ১৮৩১ সালের প্লেগ সেই শহর দুটিকে প্রায় জনশূন্য করে ফেলেছিল। প্লেগের আঘাতে দেড় লাখ বাসিন্দার বাগদাদে শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল মাত্র ২০ হাজার মানুষ। ৮০ হাজার নাগরিকের বসরা শহরে কোনো রকমে বেঁচে ছিল মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার বাসিন্দা। ইরাকের বহু শহর মনুষ্যহীন ভূতের নগরে পরিণত হয়েছিল। ঘরবাড়ি খালি পড়েছিল। দোকানপাট-কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। শ্রম দেওয়ার মতো শ্রমিকের খোঁজ পাওয়া যেত না। ক্ষেত-খামার পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। আবাদীজমি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের সঙ্গে অর্থনৈতিক কাঠামো পুরোপুরি ধ্বসে পড়ে।
ইরাককে তার এই দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে কুড়ি বছরের বেশি সময় লেগেছিল। (ব্লাদিমির বরিসবিচ লাট্সকি, মডার্ন হিস্ট্রি অব দ্য আরব কান্ট্রিজ, ১৯৬৯, মস্কো)
মক্কায় মহামারি
ধর্ম ও বাণিজ্যিক কারণে সারা বিশ্বের বড় যোগাযোগস্থল সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগর। প্রতি বছর হজ্জ্বের জন্য মুসলমানরা এখানে মিলিত হন। খুব স্বাভাবিক কারণেই যেখানে মানুষের চলাচল বেশি সেখানে রোগের বাসা বাঁধার আশঙ্কাও বেশি। বৈশ্বিক নানা মহামারি তাই পবিত্র এই শহরকেও আক্রান্ত করেছে বারবার।মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছে মহামারির কারণে মক্কার হজ্জ্ব প্রায় চল্লিশ বার বাতিল করতে হয়েছিল। হজ্জ্ব মুসলমানদের অবশ্যপালনীয় ইবাদত। তাই একেবারে বাধ্য না হলে তা বাতিল করার কোনো সম্ভাবনা নেই। অবশ্য প্রতিবারই মহামারির কারণে যে বাতিল হয়েছে তা নয়। রাজনৈতিক সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহের কারণেও বাতিল হয়েছিল।
১৮৩১ সালের প্লেগ
মহামারির কারণে যে কয়বার হজ্জ্ব বন্ধ ছিল তার মাঝে রয়েছে ১৮৩১ সালের প্লেগ। এই প্লেগের উৎসভূমি ভারত। সেখান থেকে সংক্রমিত হয়ে আসে মক্কায়। প্লেগে তিন-চতুর্থাংশ হজ্জ্বযাত্রীর মৃত্যু হলে সেবার হজ্জ্ব বাতিল করতে হয়।
থেমে থেমে মহামারি
১৮৩১ সালের পর ১৮৩৭ সালে আবার মহামারি দেখা দেয়। এ প্লেগের আঘাতে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত লাগাতার হজ্জ্ব বন্ধ থাকে। তার পাঁচ বছর পর ১৮৪৬ সালে কলেরা মহামারি শুরু হয়। তাতে পনের হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এ মহামারি ১৮৫০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ১৮৫৮ সালে আরেকটি বৈশ্বিক কলেরা মহামারি মক্কায় ছড়িয়ে পড়ে। মিশরীয় হজ্জ্বযাত্রীরা এতে লোহিত সাগরে পালিয়ে যায়। সেখানেই তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। তারপর বিরতি দিয়ে আবারো ১৮৬৫ ও ১৮৮৩ সালে ফিরে আসে কলেরা। এ জন্য বারবার হজ্জ্ব স্থগিত রাখতে হয়।
কলেরার মুখে ওমান
১৮১৭ সালে ভারতীয় বাণিজ্যিক জাহাজের মাধ্যমে কলেরাবাহী একদল নাবিক মাস্কাটে এলে ওমানে কলেরার সূচনা হয়। ভারত ও আফ্রিকান বাণিজ্যিক জাহাজের প্রধান আকর্ষণ ছিল ওমানের বন্দর। ফলে এখানে খুব সহজেই ঘটেছে সংক্রমণ। এতে শেষ পর্যন্ত প্রাণ যায় পঁচিশ মিলিয়ন মানুষের।
১৮১৭ সালের কলেরাই শেষ নয়, এরপর ওমানে বারবার ফিরে আসতে থাকে এ মহামারিটি। দ্বিতীয় দফায় আসে ১৮৬৫ সালে। এবার শুধু মাস্কাটেই প্রাণ যায় ৬০০ মানুষের। কাছের আরেকটি শহরে মারা যায় আরো ১৭০০ জন।
১৮৯৯ সালে ওমানে ঘটে কলেরার তৃতীয় দফা আক্রমণ। দৈনিক তিন শ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে থাকে এতে। নভেম্বরের দিকে মৃতের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসে।
ফিরে ফিরে আসে মহামারি
১৭২০ সালে প্লেগ, ১৮২০ সালে কলেরা, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু, ২০২০ সালে কোভিড-১৯!প্রতি একশ বছর পরপর একটি মহামারি। শত্রুর সঙ্গে লড়াই করেই মানুষকে টিকে থাকতে হচ্ছে। কেন যেন মনে হয় ভালো করে বাঁচার জন্য আমাদেরকে ইবনে খালদুনের সেই কয়েক লাইনের বক্তব্যটিকেই মানতে হবে। শহরের সূর্যের আলো, নির্মল বাতাস আটকে রেখে ভালো থাকা যায় না। জল আর বায়ুর দূষণ বাড়াতে থাকলে আমাদের আয়ু দীর্ঘ হতে দেবে না প্রকৃতি।
মিশরীয় লেখক ত্বাহা হুসাইনের মতো মিঠা গদ্যের আত্মজৈবনিক বয়ানে তিনি বলছেন,’দিনটি ছিল ২১ আগস্ট ১৯০২। সেবারের গ্রীষ্মকালটা ছিল বড় অদ্ভুত। কলেরা মহামারি মিশরকে চেপে ধরেছিল। লুটে নিচ্ছিল বাসিন্দাদের। শহর-জনপদ ধ্বংস করে দিচ্ছিল। মুছে দিচ্ছিল সমস্ত পরিবার। …বিদ্যালয় বন্ধ। চিকিৎসক রোগী দেখছেন আর আতঙ্কে কেঁপে উঠছেন।’ (আল-ইয়াওম)
এই সময়ের সঙ্গে কি অদ্ভূত মিল!