ঐতিহ্যবাহী কিন ব্রিজ, আলী আমজাদের ঘড়ি ও আসাম প্যাটার্ণের বাংলোর স্থাপত্যশৈলী এই তিনের মিশেলে নির্মাণ করা হয়েছে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। নির্মাণশৈলী ও নান্দনিকতার কারণে এটিদেশের অন্যতম নান্দনিক বাস টার্মিনাল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় ১১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাস টার্মিনালটির কাজ শেষ হয়েছে বছর দু‘য়েক আগে। ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে টার্মিনালটি চালু করা হয়। এরপর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার প্রয়োজন মনে করছে না সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। শুধু তাই নয়, টার্মিনালটি ইজারা দিয়েই দায় সেরেছে সিসিক।
যার কারণে তদারকির অভাবে অনেকটা বছর ঘুরার আগেই ‘পরিত্যক্ত‘ অবস্থা দেশের সর্বাধুনিক এই টার্মিনালটির। জং পড়েছে দামি দামি চেয়ারে। খসে পড়ছে লাইট। ওয়াচ টাওয়ারটি এখন ভূতের বাড়ি। ভিআইপিদের জন্য বসার স্থান ও নামাজের জায়গায় জাল বেঁধেছে মাকড়শা। আর দামি দামি কাচের গ্লাসে আবরণ পড়েছে পরিবহণ নেতাদের নির্বাচনী লিফলেট।
সিলেট সিটি করপোরেশন বলেছে, বাস টার্মিনালটি ইজারা দেওয়া হয়ে গেছে। এখন আর নতুন করে উদ্বোধন করা হবে না। এভাবেই চলবে।
পরিবহন মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম আহমদ টার্মিনালটি ইজারা নিয়েছেন। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন পরিবহন নেতাও রয়েছেন দেখাশোনার দায়িত্বে।
সিসিক সূত্রে জানা গেছে, মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্ট সার্ভিস প্রজেক্ট (এমজিএসপি) প্রকল্পের আওতায় সিলেট সিটি করপোরেশন সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল আধুনিকায়নের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রায় ৮ একর জমির ওপর এই টার্মিনাল নির্মাণ কাজে ব্যয় ধরা হয় ১১৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে ডাম্পিং গ্রাউন্ডের জন্য ৫৬ কোটি টাকা এবং টার্মিনালের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৬১ কোটি টাকা।
দৃষ্টিনন্দন এই টার্মিনালে বিমানন্দরের আদলে বহির্গমন, আগমনের আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। স্থাপনার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে গোলাকার পাঁচতলা একটি টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে টার্মিনাল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কার্যালয়, কন্ট্রোল রুম, পুলিশ কক্ষ এবং পর্যটন কার্যালয় স্থাপন করার কথা ছিল। তাছাড়া যাত্রী উঠানামার জন্য পৃথক টার্মিনাল ভবন, সুপরিসর পার্কিং ব্যবস্থা, পরিবহন সেবাদানকারীদের জন্য যাবতীয় সুবিধা সম্বলিত পৃথক ভবন, রেস্টুরেন্ট ও ফুড কোর্ট, পর্যাপ্ত যাত্রী বিশ্রামাগার, নারী, পুরুষ ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য আলাদা আলাদা শৌচাগার, ব্রেস্ট ফিডিং জোন, স্মোকিং জোন, ছোট দোকান, অসুস্থ যাত্রীদের জন্য সিক বেড, প্রার্থণা কক্ষসহ সব ধরনের আধুনিক সেবা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে এই স্থাপনায়।
এছাড়া পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সভা অনুষ্ঠানের জন্য বিশাল হলরুম এবং যানবাহনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়ার্কশপ স্থাপন করা হয়েছে।
দৃষ্টিনন্দন এই টার্মিনালের বহির্গমন ভবনের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৩০০ ফুট। এই অংশে ৪৮টি বাস একসঙ্গে দাঁড়াতে পারবে। এ ছাড়া যাত্রীদের বসার জন্য রয়েছে ৯৭০ আসনের বিশাল হল। রয়েছে ৩০ আসনের ভিআইপি কক্ষ, ৩০টি টিকিট কাউন্টার ও নামাজের জন্য আলাদা কক্ষ।
২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে টার্মিনালটি চালু করেন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। কিন্তু এর কিছু দিন পরই নির্মাণে ত্রুটি ধরা পড়ে। এ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে পড়ে সিসিক। পরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
সরেজমিনে ঘুরে অত্যাধুনিক সেবা ও সুবিধার ভিন্ন চিত্রের দেখা মিলেছে। টার্মিনালের অভ্যন্তরে যাত্রীদের আনাগোনা নামমাত্র, দিনভরই ফাঁকা। বসার আসনগুলো অপরিচ্ছন্ন ও ময়লায় ভরপুর। কোনো কোনো জায়গায় বসার বেঞ্চ ভেঙেপেড়েছে। কোথাও আবার স্ট্যান্ড আছে কিন্তু চেয়ার নেই। কয়েকটি ফটকে প্রবেশের কাঁচের দরজা-জানালা উধাও। টাকার বিনিময়ে টয়লেট সেবা থাকলেও অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর। সার্ভিস প্রদানের জন্য স্থাপিত কার্যালয়সমূহ বন্ধ এবং তালা ঝুলানো। প্রবেশের দরজাসহ সম্পূর্ণ টার্মিনালের অধিকাংশ জায়গায় শ্রমিক সমিতির নির্বাচনের ব্যানার ও স্টিকারে ভরে গেছে।
তাছাড়া গোলাকার ৫ তলাবিশিষ্ট টাওয়ার ভবনে তালা ঝুলানো রয়েছে। যেখানে টার্মিনাল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কার্যালয়, পুলিশ ও পর্যটন পুলিশের কার্যালয়ের কোন কক্ষের তথ্যই পাওয়া যায়নি। তবে টার্মিনালের ১ম অংশের দ্বিতলে নিরাপত্তা ও সিসিটিভি মনিটরিংয়ের একটি ছোট কক্ষের দেখা মিলেছে। যা পরিত্যক্ত ও তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে।
নাগরিক ও যাত্রীদের আধুনিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে অত্যাধুনিক এ বাস টার্মিনাল নির্মিত হলেও যাত্রীরা অনেকটাই বিমুখ। সরেজমিনে দেখা গেছে, কদমতলী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে হুমায়ুর রশিদ চত্ত্বর পর্যন্ত রাস্তার পাশ দিয়ে সিলেট বিভাগীয় জেলাসমূহের এবং দুরপাল্লার বাস কাউন্টার রয়েছে, তবে নবনির্মিত টার্মিনাল কমপ্লেক্সের থেকে এসব কাউন্টারে যাত্রীদের উপচে পড়া ভীড়।
চট্টগ্রামের যাত্রী মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, নতুন টার্মিনাল হয়েছে, সেখানে সুবিধাও অনেক। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউন্টার খুজে পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হয়। এর থেকে রাস্তার পাশেই কাউন্টার রয়েছে। এখান থেকে সহজেই টিকিট পাওয়া যায় এবং যাত্রা করা যায়। এজন্য টার্মিনাল কমপ্লেক্সে যাওয়া হয় না তেমন। এছাড়া টার্মিনালের সামনে থাকা বিভিন্ন কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতারা বিরক্ত ও টানাটানি করেন বলে সেখানে যান না বলেও জানান এ যাত্রী।
তবে টার্মিনালের ভেতরে দিকে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার ও সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার স্থানীয় বাসের কাউন্টার থাকায় যাত্রীদের আনাগোনা দেখা গেছে। তাছাড়া এসব কাউন্টার কেন্দ্রীক বাসগুলোও রাস্তা ছেড়ে টার্মিনালের ভিতরে অবস্থান করছে, এতে রাস্তার উপর গাড়ি ও যাত্রীদের চাপ কমছে বলে মন্তব্য যাত্রী ও বাস চালকদের।
সিলেট-জকিগঞ্জ রুটের বাস চালক সুজাত মিয়া বলেন, প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানায় এমন সুন্দর একটি টার্মিনাল তৈরি করার জন্য। বিভিন্ন সুবিধা বেড়েছে এ টার্মিনালে। তবে রাস্তার উপর গাড়ির চাপ কমেনি, যানজট লেগেই থাকে। তবে বলতে পারি, উপজেলাসমূহ ও বিভাগের অন্য জেলার বাস কাউন্টার টার্মিনালের ভিতরের দিকে হওয়াই রাস্তার উপর থেকে স্থানীয় এসব যানবাহনের চাপ কমেছে।
এ বিষয়ে সিলেট বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম বলেন, টার্মিনালটি চালুর পর থেকে সিটি করপোরেশন কোনো তদারকি করছে না। টার্মিনালের অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু সিসিকের কেউ খোঁজ খবর নিচ্ছে না। সিটি কর্তৃপক্ষের সাথে ইজারাদারেরও গাফিলতি রয়েছে বলেন তিনি।
এ বিষয়ে টার্মিনালের ইজারাদার সেলিম আহমদ বলেন, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে ৫৬ লাখ টাকায় আগামী এক বছরের জন্য ইজারা পেয়েছি আমরা। এখানে ২ লক্ষ টাকা সমপরিমাণের খরচের রক্ষণাবেক্ষণে কাজ আমাদের হাতে, বাকী বড় কোন সংস্কারের প্রয়োজন পড়লে তা সিটি কর্পোরেশন দিবেন। আমরা নিয়মিত তদারকি করি, বেশ কিছু সমস্যা এসেছে। সিটি কর্পোরেশনের সাথে সমন্বয়কে করে দ্রুত তা সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, টার্মিনালটি ইজারা দেওয়া হয়ে গেছে। এখন দেখাশোনার দায়িত্ব ইজারাদারের। তাছাড়া এটি আর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার প্রয়োজন নেই। এভাবেই চলবে।
টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছোটখাটো সমস্যা হলে ইজারাদার মেরামত করবেন। তবে বড় কোনো সমস্যা হলে সিটি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখবে।
শেয়ার করুন