জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে চারদিকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, বিপিসি ৭ বছর লাভে থাকার পরও কেন তেলের দাম বাড়াতে হলো। লাভের টাকা গেলো কোথায়? সে প্রশ্নের উত্তর ও ব্যাখ্যা দিলেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ।
বুধবার (১০ আগস্ট) কারওয়ান বাজারে বিপিসি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন।
বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত জ্বালানি খাতে ক্রমাগত লোকসান গুণতে হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার ৫ কোটি টাকা। এ খাতে ভর্তুকির বিনিময়ে সরকার বিভিন্ন সময়ে ৪৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা বিপিসিকে দেয়। ওই সময়ে আরও প্রায় ৮ হাজার ১২৭ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল, যা পরে বিপিসির মুনাফার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত সেটি বহাল আছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের প্রতি ব্যারেল কেনায় খরচ পড়তো ৯৬ দশমিক ৯৫ ডলার। আমরা যখন এটাকে কস্টিং (মূল্য নির্ধারণ) করি, প্রতি লিটার পড়ে ৮৩ টাকা ৬ পয়সা। ওই সময়ে বিপিসি বিক্রি করতো ৮০ টাকা করে। সেখানে লিটারে ৩ টাকার মতো লোকসান ছিল।
এ বি এম আজাদ বলেন, আবার ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন প্রতি ব্যারেল ১০৮ ডলার ৫৫ সেন্ট, সেটাকে টাকায় প্রতি লিটারে কনভার্ট করলে হয় ৮৯ টাকা ৮৫ পয়সা। তখনও বিপিসি বিক্রি করেছে ৮০ টাকা লিটার। যে কারণে ফেব্রুয়ারিতে প্রতি লিটারে ৯ টাকার মতো লোকসান গুনতে হয়েছে। এভাবে বাড়তে বাড়তে গত জুলাই মাসে প্রতি ব্যারেলের মূল্য ছিল ১৩৯ দশমিক ৪৩ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি লিটারে কনভার্ট করলে খরচ পড়তো ১২২ টাকা ১৩ পয়সা। তখনও ওই তেল বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়। এভাবে তেলের দাম বাড়তে বাড়তে জুলাই মাসে প্রতি লিটারে লোকসান এসে দাঁড়িয়েছিল ৪২ টাকা ১৩ পয়সা।
বিপিসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, এ পরিস্থিতিতে গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিপিসির প্রকৃত লোকসান ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা। দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিপিসি বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। নতুন করে ১১টি প্রকল্প হাতে রয়েছে, যার খরচ প্রায় ৩৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকার অধিক। ইআরএল ইউনিট-টু, যাতে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হবে। এটি বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে বিপিসির মুনাফার একটি অংশ এফডিআর করা হয়।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন, বিপিসির অর্থ কোনো না কোনো ব্যাংকের হিসাবের বিপরীতে রাখতে হয়। প্রকল্পের যে অর্থ, সেগুলো প্রকল্পের নামে এফডিআর খুলে রাখা হয়। সরকারের কাছ থেকে কোনো ভর্তুকি না নিয়ে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা টাকা থেকে গত ৬ মাসের জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
এ বি এম আজাদ বলেন, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রতি লিটার ডিজেলে ১২০ টাকা খরচ হচ্ছে বিপিসির। এ ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ৬ টাকার মতো লোকসান দিতে হচ্ছে। তবে অকটেনে ২৫ টাকার মতো লাভ হচ্ছে।
উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য তেলের দাম বাড়ানো হয়নি। ক্রুডের কারণে পেট্রল ও অকটেনের দাম বাড়ে। সুতরাং পেট্রল ও অকটেনের দাম কৌশলগত কারণে বাড়াতে হয়েছে, দাবি করেন বিপিসি চেয়ারম্যান।
এ প্রসঙ্গে বুধবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এক আলোচনায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রশ্ন রেখে বলেন, গত সাত বছরে (২০১৫-২১) বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা লাভ করেছে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা গেলো কোথায়?
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ১২৬ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ৯ হাজার ৪০ কেটি, ২০১৭ সালে ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি ও ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। এছাড়া ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭৬৮ টাকা, ২০২০ সালে ৫ হাজার ৬৭ কোটি এবং ২০২১ সালে বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা লাভ করেছে। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য পেয়েছি। বিপিসি সব সময় জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভ করেছে। তাহলে এখন কেন ভর্তুকি তুলে নেওয়া হলো?
বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায়? ১০ হাজার কোটি টাকা সরকার নিয়েছে। বিপিসির বাকি টাকা কোথায় গেলো? শুনেছি প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু টাকা খরচ করা হয়েছে। আমরা দেখছি বিপিসি নাকি সবচেয়ে ধনী গ্রাহক। বিপিসির ২৫ হাজার কোটি টাকা অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে। তাহলে এসব টাকা কার? বিপিসি চাইলে এই সংকট সময়ে জ্বালানি তেলের ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে পারতো’- বলেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
শেয়ার করুন