ধর্ষণের শিকার নারীর মেডিকেল পরীক্ষায় ‘টু ফিঙ্গার’ (দুই আঙুলের মাধ্যমে পরীক্ষা) পদ্ধতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় প্রকাশ করা হয়েছে। এ রায় প্রকাশ করেছেন বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি এ কে এম সাহিদুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
বুধবার (৩০ আগস্ট) এ তথ্য জানিয়েছে রিটকারী সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।
রায়ে আটটি নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। সেগুলো হলো:
১. ধর্ষণের শিকার নারীর ক্ষেত্রে দুই আঙুলের পরীক্ষা অবৈজ্ঞানিক, অনির্ভরযোগ্য এবং অবৈধ। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই আঙুলের পরীক্ষা নিষিদ্ধ।
২. রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হেলথ রেসপনস টু জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স- প্রটোকল টু হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার-এ প্রোটকলটি সকল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, ফিজিশিয়ান যারা ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষা করেন, পুলিশ কর্মকর্তা যারা ধর্ষণের মামলার তদন্ত করেন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলার সরকারী প্রসিকিউটর এবং আইনজীবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।
৩. ডাক্তাররা ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার সনদে ধর্ষণের বিষয়ে মতামত দেবেন, কিন্তু কোনোভাবেই অমর্যাদাকর শব্দ, যেমন- অভ্যাসগতভাবে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত ব্যবহার করতে পারবেন না। ধর্ষণের শিকার নারীকে তার অতীতের যৌন সম্পর্ক সম্পর্কে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন না।
৪. ধর্ষণের শিকার নারীর যৌনাঙ্গে কোনো গভীর ক্ষত পরীক্ষার জন্য গাইনি বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে হবে।
৫. কোনো শিশু বা কিশোরী মেয়ের ক্ষেত্রে পার স্পেকুলাম এক্সামিনেশন পরীক্ষা করা যাবে না, যদি না কোনো বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন থাকে।
৬. বায়ো ম্যানুয়াল পরীক্ষার সঙ্গে দুই আঙুলের পরীক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি গাইনি পরীক্ষা এবং ধর্ষণের শিকার নারীর ক্ষেত্রে এ পরীক্ষা করা যাবে না।
৭. ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার জন্য প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও সেবিকাদের নিয়োগ করতে হবে। এ পরীক্ষার সময়ে সুবিধা অনুযায়ী নারী পুলিশ, একজন নারী আত্মীয়ের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং সুবিধা অনুযায়ী একজন নারী ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করতে হবে। কর্তব্যরত ডাক্তার এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা এ পরীক্ষার ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করবে।
৮. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি নিশ্চিত করবে যে, আদালতে ধর্ষণের শিকার নারীর জিজ্ঞাসাবাদে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এমন কোনো প্রশ্ন আইনজীবী করবেন না।
আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট মাসুদা রেহানা রোজী, অ্যাডভোকেট আইনুন্নাহার সিদ্দিকা ও ব্যারিস্টার শারমিন আক্তার।
এর আগে, ২০১৬ সালে এ পদ্ধতিকে ‘সেকেলে ও অনৈতিক’ বলে হাইকোর্টে মৌখিকভাবে মতামত উপস্থাপন করেছেন পাঁচ ফরেনসিক মেডিকেল বিশেষজ্ঞ। বিশেষজ্ঞরা আদালতে বলেছিলেন, এটি সেকেলে পদ্ধতি। যৌন নির্যাতনের পরীক্ষার আধুনিক অনেক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে।
সে সময় হাইকোর্টে মৌখিক অভিমত দিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী, একই হাসপাতালের ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইল ল্যাবরেটরির প্রধান ডা. সাফিউর আখতারুজ্জামান, মিরপুরের ডেল্টা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জাহিদুল করিম আহমেদ, বারডেম হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিনের প্রফেসর ডা. গুলশান আরা ও ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন অব ল’, মেডিসিন অ্যান্ড সায়েন্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট মুজাহিরুল হক।
সনাতন পদ্ধতিতে (দুই আঙুলের মাধ্যমে পরীক্ষা) ধর্ষিতার মেডিকেল পরীক্ষা করার কারণে অনেক ভুক্তভোগী পরীক্ষা করাতে আসেন না। আর এ কারণে অনেকে ধর্ষিত হয়েও বিচার পান না। ভারতে এ পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। সনাতন পদ্ধতিটি একজন নারীর জন্য চরম বিব্রতকর ও অবমাননাকর।
নতুন ও আধুনিক মানবিক পদ্ধতি প্রবর্তন করার জন্যই আবেদনটি করা হয়, যাতে করে নারী দ্বিতীয়বার অবমাননার শিকার না হন। যাতে করে ধর্ষিতা নারী সঠিক ও মানসম্পন্ন সর্বাধুনিক মানবিক পদ্ধতিতে মেডিক্যাল পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সুবিচার পান।
এসব বিষয় নিয়ে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নারীপক্ষ এবং ডা. রুচিরা তাবাচ্ছুম ও ডা. মোবারক হোসেন খান রিট আবেদনটি দায়ের করেন। ওই রিটের ওপর জারি করা রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন আদালত।
শেয়ার করুন