সরকার যখন মহামারি করোনায় গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলো না নিয়েই শিক্ষার্থীদের অটোপাস দিচ্ছিলেন জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট না হওয়ার জন্য, তখন বিয়ানীবাজারের আছিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকবৃন্দ নিদারুন অবহেলায় ধ্বংস করেছেন ৮ শিক্ষার্থীর মহামূল্যবান একটি বছর।
তারা এবার আর এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারছে না। অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ২০২৪ সালের। তবে তাও সুস্থ স্বাভাবিক থাকলে। কারণ, ইতিমধ্যে একজন শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করেছে। অন্যরাও দিনাতিপাত করছে গভীর হতাশাগ্রস্ত অবস্থায়।
ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। কারণ, এমনিতে তাদের জীবনের এক বছর গিলে খেয়েছে শিক্ষকদের হেলাফেলা। ভবিষ্যতে নতুন কোন সমস্যায় তারা পড়তে চায়না। তবে অভিভাবকদের কারো কারো মুখের দিকে তাকানোর কোন উপায়ই নেই। রাজ্যের হতাশা গিলে খাচ্ছে তাদেরও। আর শিক্ষকবৃন্দের একজন মিথ্যা আশ্বাসে আশ্বাসে এতদিন তাদের রাখলেও এখন মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, এই আট শিক্ষার্থী ২০১৯ সালের জেএসসি পরীক্ষায় একটি বিষয়ে রেফার্ড পেয়েছিল। নবম শ্রেণীতে ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলআপ করার কথা থাকলেও একজন সহকারী শিক্ষকের ভুলে তা করা হয়নি। তখন মহামরি করোনায় স্কুল বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীদের বিষয়টি অবগত করে ফরম ফিলআপ করার কথা ছিল সহকারি শিক্ষক রাকিব আহমদের। তার কাছেই বাচ্চাদের প্রবেশপত্রসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট রাখা ছিল বলে দাবি সূত্রগুলোর। অভিভাবক এবং এলাকাবাসী জানিয়েছেন, একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক হলেও রাকিব আরও নানা ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তার পক্ষে এমন ভুল অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ওই শিক্ষার্থীরা নবম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়। দু’বছর পর ২০২২ সালে নির্বাচনী পরীক্ষার আগে হঠাৎ একদিন তাদের স্কুলে ডেকে নিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, তারা এবার এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারবেনা। এসএসসি দিবে ২০২৪ সালে।
শিক্ষকদের এমন কথায় তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। অভিভাবকরা ছুটে আসেন স্কুলে। এরমধ্যে একজন প্রভাবশালী অভিভাবক এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানিয়েছেন, প্রধান শিক্ষক তার কাছে বিষয়টি নিয়ে খুব অনুনয়-বিনয় করেছেন। বিষয়টি ছেড়ে দিতে বলেছেন। তিনি চেষ্টা করছেন, বোর্ড বিষয়টি সমাধান করে দিলে বাচ্চারা পরীক্ষা দিবে অন্যতায় যেন বিষয়টি মাফ করা হয়।
ব্যস! আর কোন অভিভাবককে বিষয়টি ঠিকমতো ব্যাখ্যাও করা হয়নি। একজন অভিভাবক প্রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, প্রধান শিক্ষক শফিউল আলম তাদের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বোর্ডে যোগাযোগ রাখছেন। সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন। এদিকে আমার ছেলে হতাশাগ্রস্ত অবস্তায় এখন অনেকটা উন্মাদপ্রায়।
এরই মধ্যে আসে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস। স্কুলের নির্বাচনী (টেস্ট) পরীক্ষা শুরুর তোড়জোড় চলছিল তখন। কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলে তিনি জানিয়ে দেন, তাদের নির্বাচনী পরীক্ষা দিতে হবেনা। বোর্ডে বিষয়টির সমাধান হলে, নির্বাচনী পরীক্ষা ছাড়াই তাদের ফরম ফিলআপ করে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে।
বিষয়টি নিয়ে গত ডিসেম্বরেই এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপ হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. রমা বিজয় সরকারের সাথে। তিনি এরকম কোন আবেদন বা অনুরোধের বিষয় জানেন না জানিয়ে স্কুল পরিদর্শকের সাথে কথা বলতে বলেন।
বিষয়টি নিয়ে স্কুল পরিদর্শক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামের সাথে অন্তত তিন দফা আলাপ হয় এ প্রতিবেদকের। বরাবরই তিনি এ বিষয়ে নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করে অফিসের যাওয়ার কথা বলেন।
এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে কেউ আবেদন করলে জানা থাকার কথা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। কিন্তু তারা অজ্ঞতা প্রকাশ করায় প্রধান শিক্ষক শফিউল আলমের দেয়া আশ্বাসকে ¯্রফে কথার কথা বলেই মনে করছেন অভিভাবকসহ সচেতন এলাকাবাসী।
সোমবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরের দিকে প্রধান শিক্ষক শফিউল আলমের নম্বরে কল দিয়ে ঘটনা সত্য না মিথ্যা জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন নি। বলেছেন, স্কুলে গেলে যাবতীয় ডাটা দিবেন। এমনকি ২/৩ বার একই প্রশ্ন করলেও তিনি একবারও অস্বীকার করেন নি। বরং বারবার স্কুলে যাওয়ার কথা বলেন।
এ ঘটনায় দায়ী করে যার সবচে বেশী সমালোচনা হচ্ছে, সেই সহকারি শিক্ষক রাকিব আহমদের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তিনি লাইন কেটে দেন।
মোবাইল এসএমএসে নিজের পরিচয় জানিয়ে কল দিয়ে তার সহযোগীতা চাইলেও তিনি সাড়া দেন নি।
উল্লেখ্য, প্রধান শিক্ষক শফিউল আলমের খুঁটির জোর খুব বেশী বলে এলাকার কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেন না। কয়েক বছর আগে তার বিরুদ্ধে এলাকাবাসী সংবাদ সম্মেলন ডেকে নানা অনিয়মের অভিযোগ করলেও তার কিছু হয়নি। এমনকি অভিভাবকদের সাথে তার অশ্লীল আচরণ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি হলেও তিনি আছে বহাল তবিয়তে।
শেয়ার করুন