
নরসিংদীতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে দেয়াল চাপা, গাছ থেকে পড়ে এবং নির্মাণাধীন ভবনের ইট পড়ে বাবা-ছেলেসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন বিভিন্ন বয়সি শতাধিক মানুষ। তারা পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সদর হাসপাতাল ও জেলা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সন্ধ্যায় সদর হাসপাতাল ও পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ, চিনিশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ নরসিংদীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নিহতরা হলেন: সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের গাবতলি এলাকার দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল ও তার ছেলে হাফেজ মো. ওমর (৮)। পলাশ উপজেলার মালিতা পশ্চিমপাড়া গ্রামের কাজেম আলী ভূঁইয়া (৭৫) ও কাজীরচর নয়াপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে নাসির উদ্দিন (৬৫) এবং শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নের আজকীতলা গ্রামের ফোরকান মিয়া (৪৫)।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে নরসিংদী সদর ও পলাশ উপজেলার মধ্যবর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। এই ভূমিকম্পে নরসিংদী জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্পন অনুভূত হয়।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। এতে নরসিংদীসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক ভবনসহ বিভিন্ন ভবনে হালকা ফাটল দেখা দেয়। ভূমিকম্পের সময় অনেকেই আতঙ্কে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসার সময় পড়ে গিয়ে আহত হয়।
যেভাবে মারা গেলেন ৫ জন
সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের গাবতলি এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল থেকে ইট ধসে পাশের বসতবাড়ির ছাদের ওপর আছড়ে পড়ে। মুহূর্তেই বাড়ির সানশেড ভেঙে হফেজ মো. ওমর (৮), তার বাবা দেলোয়ার হোসেন ও দুই বোন আহত হয়। তাদের প্রথমে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাবা ও ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে নিয়ে গেলে ছেলে মো. ওমরকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। বাবা দেলোয়ার হোসেন চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যায় মারা যান।
হাসপাতালে থাকা ওমরের চাচা জাকির হোসেন বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় দোলোয়ার তার ওমর ও দুই মেয়েকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছিলেন। এ সময় বাড়ির সানশেড ভেঙে তাদের ওপর পড়ে। পরে সবাই মিলে তাদেরকে আহত অবস্থায় হাসপাতাল নিয়ে গেলে দেলোয়ার ও ওমরকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করে।’
এদিকে পলাশ উপজেলার মালিতা পশ্চিমপাড়া গ্রামের কাজেম আলী ভূঁইয়া (৭৫) মাটির ঘরের দেয়ালের নিচে চাপা পড়েন। সেখান থেকে তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে নরসিংদী ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আব্দুল্লাহ আল মামুন। এছাড়া কাজীরচর নয়াপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে নাসির উদ্দিন (৬৫) ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে স্ট্রোক করে মারা গেছেন বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন।
অপরদিকে শিবপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আফজাল হোসাইন জানান, ভূমিকম্পের সময় গাছ থেকে পড়ে আহত হলে শিবপুর উপজেলা হাসপাতালে আনার পর মারা গেছেন শিবপুর উপজেলার ইউনিয়নের আজকীতলা পূর্বপাড়া গ্রামের শরাফত আলীর ছেলে ফোরকান মিয়া (৪৫)।
ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগুন
ভূমিকম্পে ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সাবস্টেশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পুড়ে যায়। যার কারণে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ে।
পলাশ ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. আব্দুল শহিদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘খবর পেয়ে পলাশ ফায়ার সার্ভিসের ২টি ইউনিটের চেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।’
ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মো. এনামুল হক জানান, ভূমিকম্পে এ আগুনের ঘটনা ঘটে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে কাজ চলছে।
বিভিন্ন ভবনে ফাটল
পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৪টি আবাসিক ভবনে কিছুটা ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল বাজারের ছয়তলা বিল্ডিং এসএ প্লাজায় ফাটল দেখা দেয়। বিল্ডিং এ মারকাযুস্ সুন্নাহ তাহ্ফীজুল কুরআন মাদ্রাসা রয়েছে। মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি সালাহ উদ্দীন আনসারী ফাটলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এছাড়া ঘোড়াশালের লেবুপাড়া এলাকায় ঘোড়াশাল ডেইরি ফার্মের মাঠের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এছাড়া পলাশ রেসিডেনসিয়াল স্কুলের পাশে একটি বিল্ডিং এ ফাটল দেখা দিয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। ঘোড়াশাল নতুন বাজার গ্রামের ইসহাক মিয়ার বাড়ি ভেঙে পড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত পাইকারি কাপড়ের হাট নরসিংদীর শেখেরচর বাবুরহাট বাজারের ধূমকেতু মাঠে একটি চারতলা ভবন সামান্য হেলে গেছে।
শহরের গাবতলী এলাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আরাফাত শাহ বলেন, ‘ভূমিকম্পে আমার চারতলা বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন দেয়ালের টাইলস ভেঙে পড়ে। এতে বিভিন্ন আসবাবপত্র ভেঙে গেছে। তবে বাসার সবাই সুস্থ আছি, কিন্তু আতঙ্কে রয়েছি। বিশেষ করে বাচ্চারা অনেক ভয় পেয়েছে।
হাসপাতালের চিত্র
ভূমিকম্পে শহরের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বিভিন্ন ভবন, বসতবাড়ি, মার্কেট ও দোকানপাট থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে অনেকে আহত হয়েছেন। এছাড়া ভূমিকম্পের সময় অনেকে মাথা ঘুরপাক খেয়ে পড়ে গিয়ে, বুকে ব্যথা নিয়ে ও স্ট্রোক করে আহত হয়েছেন।
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বলেন, ‘ভূমিকম্পের প্রভাবে সদর, পলাশ ও শিবপুরে শিশুসহ মোট ৪ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছি। শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। বিভিন্ন টিমের মাধ্যমে সমন্বয় করে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। সরকারের নির্দেশনামতে পরবর্তীতে সবধরনের সহায়তা করা হবে।’
এসব ঘটনায় আহতদের মধ্যে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ৫৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে ১০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অর্ধশত চিকিৎসা নিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন সিভিল সার্জন সৈয়দ আমীরুল হক শামীম। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় অর্ধশত প্রাথমিক চিকিৎসা নেন বলে জানান স্থানীয়রা।
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বলেন, ‘ভূমিকম্পের প্রভাবে সদর, পলাশ ও শিবপুরে শিশুসহ মোট ৪ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছি। শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। বিভিন্ন টিমের মাধ্যমে সমন্বয় করে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। সরকারের নির্দেশনামতে পরবর্তীতে সবধরনের সহায়তা করা হবে।’



