সম্প্রতি পবিত্র মক্কানগরীর কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, পবিত্র কাবাঘরের বেশ কাছের কয়েকটি পাহাড়, মাঠঘাট ও সড়কের দুই পাশ সবুজ তৃণলতায় ছেয়ে গেছে। ছবিগুলোর ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘সাম্প্রতিক বৃষ্টির পর মক্কার সবুজ দৃশ্য’। সৌদি আরবে বসবাসরত একাধিক বাংলাদেশিও তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
এই পোস্টে অনেককেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মন্তব্য করতে দেখা যায়। তবে বেশির ভাগ মন্তব্যকারীকে মহানবী (সা.)-এর একটি হাদিস স্মরণ করিয়ে দিয়ে মানুষকে সতর্ক করতে দেখা যাচ্ছে। হাদিসটি এ রকম—‘আরবভূমিতে যত দিন তৃণলতা ও নদী-নালা ফিরে আসবে না, তত দিন কেয়ামত হবে না।’ (মুসলিম)
এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে চলছে তুমুল আলোচনা। এ লেখায় আমরা কোরআন-হাদিসের আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
কেয়ামতের আলামত
আরবি কেয়ামত শব্দের অর্থ উঠে দাঁড়ানো। মহাবিশ্বের আয়ু যেদিন ফুরিয়ে যাবে, সেদিন ইসরাফিল (আ.)-এর প্রথম ফুঁকের মাধ্যমে নশ্বর জগতের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এবং দ্বিতীয় ফুঁকের মাধ্যমে সব সৃষ্টি ফের জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে। এটিই ইসলামের পরিভাষায় কেয়ামত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শিঙায় ফুঁক দেওয়া হবে, ফলে আসমান-জমিনের সবাই মূর্ছা যাবে, তবে আল্লাহ যাদের রক্ষা করতে চাইবেন, তারা ছাড়া। এরপর আবার শিঙায় ফুঁক দেওয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকবে।’ (সুরা যুমার: ৬৮)
কেয়ামত কখন হবে—তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। যেমন, পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কেয়ামতের জ্ঞান কেবল তাঁরই জানা…।’ (সুরা হা-মিম-সাজদা: ৪৭)
মহানবী (সা.) হাদিসে পাঁচটি গোপন তথ্যের কথা বলেছেন, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। এর মধ্যে প্রথমটিই হলো—কেয়ামত কখন হবে। (বুখারি)
তবে কোরআন-হাদিসে কেয়ামতের অনেকগুলো আলামতের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ছোট আলামত, কিছু বড় আলামত। বড় আলামতগুলো কেয়ামত খুব কাছে এলেই দৃশ্যমান হবে। হাদিসে ১০টি বড় আলামতের কথা এসেছে। যেমন, দাজ্জালের আবির্ভাব, ইমাম মাহদির আগমন ইত্যাদি। আর ছোট আলামতের সংখ্যা ৩০ টির কাছাকাছি। প্রায় সব ছোট আলামতই এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, মহানবী (সা.)-এর জন্ম ও মৃত্যুর ঘটনাও কেয়ামতের অন্যতম ছোট আলামত। তেমনি মুসলমানদের বায়তুল মোকাদ্দাস ও কনস্টান্টিনোপল বিজয়ও ছোট আলামত। ছোট আলামতের মধ্যে এখনো পুরোপুরি প্রকাশ পায়নি এমন একটি হলো—আরব ভূখণ্ডে তৃণলতা ও নদী-নালা ফিরে আসা।
আরবে তৃণলতা গজানো সম্পর্কে ৩টি হাদিস
এ বিষয়ে তিনটি হাদিস পাওয়া যায়। প্রথম হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরব ভূখণ্ডে তৃণভূমি ও নদী-নালা ফিরে না আসা পর্যন্ত কেয়ামত হবে না।’ দ্বিতীয় হাদিসেও একই শব্দগুলো এসেছে। তৃতীয় হাদিসে তাবুকের যুদ্ধের একটি ঘটনা প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) তাবুক সম্পর্কে মুআজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে বলেছিলেন, ‘হে মুআজ, তোমার আয়ু যদি দীর্ঘ হয়, তবে শিগগিরই তুমি এই স্থান বসতি ও উদ্যানে ভরা দেখতে পাবে।’ (মুসলিম)
হাদিসগুলোর ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেছেন, আরব উপদ্বীপের মরুভূমিগুলোতে কেয়ামতের আগে সবুজ তৃণলতা গজাবে এবং নদী-নালার সৃষ্টি হবে। হাদিসে যেহেতু ‘ফিরে আসবে’ এসেছে, তাই বোঝাই যাচ্ছে, প্রাচীন যুগের কোনো এক সময় আরবের মরু অঞ্চলে সবুজ তৃণভূমি ও নদী-নালা ছিল। কেয়ামতের আগে আবার আরবের সেই রূপ ফিরে আসবে। সাম্প্রতিক সময়ে আরবের বিভিন্ন স্থানে গবেষণা করে অনেক ভূতাত্ত্বিকই এটি নিশ্চিত হয়েছেন। (ইসলামওয়েব ডটকম)
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, আরবে দিনে দিনে শীত বাড়ছে। এমনকি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশে সম্প্রতি তুষারপাত হতেও দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির পরিমাণও বাড়ছে। এসব বিষয় আরবের মরুভূমিতে প্রাণের সঞ্চার করছে। ফসলের উৎপাদন বাড়ছে। চাষাবাদ আগের তুলনায় অনেক বেশি হচ্ছে। তবে পুরো আরব ভূখণ্ড সবুজ তৃণলতা ও নদী-নালা এখনো সৃষ্টি হয়নি—যার কথা প্রথম ও দ্বিতীয় হাদিসে বলা হয়েছে। তবে তৃতীয় হাদিসে তাবুকের যে স্থানের কথা বলা হয়েছে, তা আজ বাস্তব। তাবুকজুড়েই এখন বিভিন্ন ফল-ফলাদির বাগান, যা মহানবী (সা.)-এর সেই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (নিহায়াতুল আলম)
মক্কায় গজানো তৃণলতা কি কেয়ামতের আলামত
ওপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়ে আমরা একটি উপসংহারে পৌঁছাতে পারি। তা হলো—প্রথম ও দ্বিতীয় হাদিসে মহানবী (সা.) আরবে তৃণলতা ও নদী-নালায় ভরে যাওয়ার যে কথা বলেছেন, এটি তারই একটি সূচনা হতে পারে। তবে পুরোপুরি সেটি দৃশ্যমান বলা যাচ্ছে না। কারণ হাদিসে বলা হয়েছে, আরব ভূমিতে তৃণলতা ও নদী-নালা স্বাভাবিক হয়ে যাবে, যেমনটি এক সময় ছিল। সেই সময় এখনো আসেনি। তবে তা যে খুব শিগগিরই আসতে চলেছে, তা আরববিশ্বের সাম্প্রতিক আবহাওয়া ও জলবায়ু দেখলেই আঁচ করা যায়।
এ ছাড়া সৌদি আরব সরকার সম্প্রতি ১ হাজার কোটি গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছে। অন্য আরবদেশগুলোও সবুজায়নের জন্য বড় বড় প্রকল্প হাতে নিচ্ছে, যা আরববিশ্বকে তার আগের সবুজ শ্যামল রূপে শিগগিরই ফিরিয়ে আনবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
তবে মক্কার শুকনো পাহাড় ও মরুর বুকে সবুজ ঘাস ও তৃণলতা গজানোর পরপরই কেয়ামত হয়ে যাবে, এমন ভাবার কারণ নেই। বরং এ ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা হলো, কেয়ামত আমাদের কাছে চলে এসেছে। সেদিন আল্লাহর দরবারে আমাদের কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে। তাই তাঁর নির্দেশিত পথেই জীবন পরিচালিত করে সেদিনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়াই আমাদের কর্তব্য। সেদিন ভালো কাজ ছাড়া কোনো কিছুই আমাদের উপকারে আসবে না।
ভীষণ সংকটের সেই মুহূর্তের কথা পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা এভাবে বলেছেন, ‘এরপর যেদিন (কেয়ামতের) ধ্বংস-ধ্বনি এসে পড়বে, সেদিন মানুষ ভাই, মা, বাবা, স্ত্রী ও সন্তান থেকে পালিয়ে যাবে। সেদিন প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। সেদিন কিছু মুখ উজ্জ্বল সহাস্য ও উৎফুল্ল হবে। সেদিন কিছু মুখ ধূলিমলিন হবে; সেগুলোকে কালিমা আচ্ছন্ন করে রাখবে। এরাই আল্লাহকে অস্বীকারকারী পাপাচারী।’ (সুরা আবাসা: ৩৪-৪২)
শেয়ার করুন