স্বীকৃতি বিশ্বাস স্টাফ রিপোর্টারঃ
আজ ছটপূজা বা সূর্যপূজা । ছট্ অর্থাৎ ছটা বা রশ্মির পূজা। এই রশ্মি সূর্য থেকেই পৃথিবীর বুকে আসে। সুতরাং এই পূজা আসলে সূর্যদেবের পূজা। প্রত্যক্ষভাবে ‘ছট;-এর পূজা হলেও এই পূজার সঙ্গে জড়িত আছেন স্বয়ং সূর্যদেব।জড়িয়ে আছেন মা গঙ্গা এবং দেবী অন্নপূর্ণা।
বিগত দুই বছর করোনা সংক্রমণের কারণে করোনার বিধিনিষেধ মেনে স্বল্প পরিসরে যশোরের লালদীঘির পাড়ে সূর্যপূজা হলেও এবছর বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে যশোরে সূর্য পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতি বছর কালীপূজার পর শুক্লাপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে সূর্যদেবকে সন্তুষ্ট করতে এই পূজা করা হয়।
গতকাল রবিবার ( ৩০ অক্টোবর) সূর্যাস্তের প্রথম অর্ঘ্য এবং আজ সোমবার(৩১ অক্টোবর) সোমবার সূর্যোদয়ে দ্বিতীয় অর্ঘ্য সূর্য পূজার ক্ষণ।
গতকাল ও আজকে অনুষ্ঠিত এ পূজায় যশোরের কয়েক হাজার হরিজন সম্প্রদায়ের লোক অংশ নিচ্ছেন। পূজায় পৌরোহিত্য করছেন মহাবীর বিশ্বাস।
উল্লেখ্য, যশোরের লালদিঘি পাড়ে বিভিন্ন মানতপূরণে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী হরিজন, রবিদাস ও রজকসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের পুণ্যার্থীদের সমাগম হয় সূর্যপূজা উপলক্ষে। লালদিঘির পাড় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে পুণ্যার্থীদের পদচারণায়।
এদিন বিকেলে পূজারিরা উপবাস থেকে পূজার বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে দণ্ডি কাটতে কাটতে লালদিঘি পাড়ে উপস্থিত হন। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ মুহূর্তে পুণ্যার্থীরা দিঘিতে স্নান করে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে পূজা শুরু করেছেন পূজারীরা। হাতের কুলায় ছিল পূজার সরঞ্জাম। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে এ দিনের মতো পূজার সমাপ্তি ঘটে। সবাই বাড়িতে ফিরে যান।
আজ সোমবার সূর্যোদয়ের আগে লালদিঘির পাড়ে উপস্থিত হয়ে একই নিয়মে পূজা শুরু দিয়েছেন । সূর্য উঠলে দেবতা হিসেবে তাকে প্রণাম করে দীঘিতে স্নান করেছেব পুণ্যার্থীরা। এরপর শরবত পানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে এবছরের পূজা।
সরেজমিন দেখা গেছে, পূজা উপলক্ষে লালদিঘির পশ্চিমপাড়ে সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে এবং বর্ণিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। সূর্যপূজায় হরিজন সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোররা উৎসবে মেতে ওঠেন।
যশোর পৌরসভা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিরন লাল বিশ্বাস জানান, যশোর পৌরসভার সার্বিক সহযোগিতায় লালদিঘিতে এ পুজো হচ্ছে। তিনি বলেন, জন্ম থেকেই দেখে আসছি লালদীঘিতে সূর্য পুজা হয়। যশোরে যে সময় থেকে হরিজন সম্প্রদায়ের লোক বসবাস শুরু করেছে থেকে তখন থেকেই শুরু হয়ে অদ্যাবধি সূর্য পূজা হচ্ছে।
সূর্য পূজার কখন উৎপত্তি হয়েছিল তার কোনো স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায় না। কিন্তু কিছু পৌরাণিক আখ্যানে ছটপূজার নীতি নিয়মের সঙ্গে মিল থাকা উৎসব দেখা যায়। ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহে সূর্য বন্দনার স্পষ্ট নিদর্শন আছে। ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে গ্রীক, রোমানসহ মিশরীয় সভ্যতাসমূহেও সূর্য মূখ্য দেবতা ছিলেন। সেভাবে ঊষাও বৈদিক দেবী। বেদে উল্লেখ পাওয়া যায় তিনি হলেন পূর্বের দেবী এবং অশ্বিনীকুমারদের মাতা। অগ্নি, সোম এবং ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতা সকলের পরে তিনিই হলেন অন্যতম বৈদিক দেবী। রাত্রি হল তার ভগ্নী যাকে পৌরাণিক যুগে সন্ধ্যা এবং ছায়ারূপে কল্পনা করা হয়েছে। রামায়ণে উল্লেখ আছে রামের কুলদেবতা সূর্যের জন্য রাম এবং সীতা এই পূজা করেছিলেন। মহাভারতে উল্লেখ আছে দ্রৌপদী ধম্য ঋষির উপদেশ মতে সূর্যকে আরাধনা করে অক্ষয় পাত্র লাভ করেছিলেন। সঙ্গে মহাবীর কর্ণের কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সূর্যের উপাসনা করা উল্লেখও পাওয়া যায় । আজও ছটপূজা উদ্যাপন করা সকল মানুষকে কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সূর্য বন্দনা করতে দেখা যায়। অন্য এক আখ্যান মতে, পাণ্ডু ঋষি হত্যার পাপের প্রায়শ্চিত্তের কারণে পত্নী কুন্তীর সঙ্গে বনে থাকায় পুত্র প্রাপ্তির জন্য সরস্বতী নদীর পারে সূর্য উপাসনা এবং ব্রত করেছিলেন।
পুরাণ মতে, প্রথম মনু প্রিয়ব্রতের কোনো সন্তান ছিল না। তাই তার পিতা কাশ্যপ মুনি পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ করতে পরামর্শ দেন। এর ফলে তার পত্নী মালিনী একটি মৃত পুত্র জন্ম দিলে মৃত শিশু দেখে তারা বিলাপ করতে থাকায় আকাশ থেকে এক দিব্য কন্যা প্রকট হলেন। তিনি নিজকে ব্রহ্মার মানস পুত্রী বলে পরিচয় দিলেন এবং মৃত পুত্রকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে সে জীবিত হয়ে উঠল। এখনও ঊষা দেবী বা ছটি মায়ের মূর্তি কোলে কিছু থাকা অবস্থায় কল্পনা করা হয় এবং পুত্র প্রাপ্তির জন্য ব্রত উপাসনা করা হয়। লৌকিক দেবী হিসাবে অন্য বহু লোককথা আখ্যান হিসাবে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে এ সূর্য পূজার কথা।