দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। সিটি করপোরেশনের মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর না থাকায় মশকনিধন কর্মসূচি থমকে আছে। এ কারণে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে ঢাকা, সিলেটসহ বড় কোন নগরেই মশা মারা হচ্ছে না। নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম নেই। বিশেষজ্ঞরা আগেই আশঙ্কা করেছিলেন, আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। গত দুই মাসের প্রতিবেদনে তা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৬ হাজার ৯৯৯ জন, মৃত্যু হয় ৩০ জনের। আর জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬৯৯। ওই মাসে মৃত্যু হয় ১২ জনের।
চার সপ্তাহ ধরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ১ আগস্ট ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫১৭ জন। সপ্তাহ বাদে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৫৬৩ জনে। এর পরের সপ্তাহে সংক্রমণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯৮০ জনে। পরের দুই সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় যথাক্রমে ১ হাজার ৭৬ এবং ২ হাজার ১৮৫ জনে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৩২০ জন। আর শুধু আগস্ট মাসেই এ সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার হয়ে যায়। আগস্টের মতো মৃত্যু আগের কোনো মাসে হয়নি।
মৃত্যুহার বেশি :
দেশে ডেঙ্গুর বড় আকারে প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ২০০০ সালে। আর গত বছর (২০২৩) দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই মূলত ডেঙ্গুতে সংক্রমণ এতটা বেড়ে যায় যে তা ছিল আগের ২৩ বছরের বেশি। আগের সমস্ত বছরে যত মৃত্যু হয়নি, গত বছর তা ছাড়িয়ে যায়।
গত বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। এ হার বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে বেশি। এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম হলেও মৃত্যুহার বেশি, এবার তা শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ।
চিকিৎসকরা জানান, গত আগস্ট মাসজুড়ে ভারী বর্ষণের কারণে চলতি সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া ডেঙ্গুর মৌসুমও শুরু হয়েছে। এ কারণে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।
বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসাধীন রোগী ও চিকিৎসকরা বলছেন, গত দুই এক মাস ধরে ঠিকমতো ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে না। পাশাপাশি বৃষ্টির সময় নালা-নর্দমায় জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস মশার বংশবিস্তার ঘটছে। ভারী বর্ষণের কারণে শহরের অনেক স্থানে এখনো পানি জমে আছে। সেখানে এডিস মশা বংশবিস্তার করছে। কাউন্সিলররা না থাকায় থমকে আছে কার্যক্রম। এ কারণে মশকনিধনেও কোনো পদক্ষেপ নেই।
তিন কারণে ভয় :
ডেঙ্গু নিয়ে এবার ভয় দুটো কারণে। প্রথমত, এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ যেমন গত বছরের চেয়ে অনেক কম, মৃত্যুও কম। কিন্তু এবার মৃত্যুহার এখন পর্যন্ত গত বছরের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি।
দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গু সাধারণত বর্ষার অসুখ। কিন্তু বাংলাদেশে অন্তত ২০২২ সালের অভিজ্ঞতা হলো ওই বছর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল অক্টোবর মাসে। এবার এখন পর্যন্ত সংক্রমণ ও মৃত্যু কম হলেও আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি, বিশেষ করে বর্ষা-পরবর্তী প্রবল বৃষ্টি ডেঙ্গুর অশনিসংকেত দিচ্ছে, এমন মত দেন জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
তৃতীয়ত, এবার মশক নিধন কার্যক্রম প্রায় স্থবির। সিলেট ছাড়াও বড় কোন নগরে নেই মশক নিধন কার্যক্রম। ফলে এবার ডেঙ্গু বৃদ্ধির শঙ্কা বাড়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কাউন্সিলর বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ওই দিন থেকে পৌরসভার মেয়র ও অধিকাংশ কাউন্সিল আত্মগোপন করেন। এর পর থেকে নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো তদারকি হচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ডেঙ্গু বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একপ্রকার ‘ননফাংশনাল’ (অকার্যকর) প্রায় এক মাস ধরে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাদের কোনো সাড়া লক্ষ করা যাচ্ছে না। এদিকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে দিয়ে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে জোরদার প্রচেষ্টায় বিঘ্ন ঘটেছে।