লোডশেডিংয়ে থমকে আছে উৎপাদন ও উন্নয়ন। বিপর্যস্ত দেশ, দুর্বিষহ হচ্ছে জনজীবন। এমন পরিস্থিতিতে সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে স্থাপিত ৪০ শতাংশ হাসপাতালের জেনারেটর থাকলেও তা অচল হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অনেক হাসপাতালে নেই জেনারেটর। ফলে ছোটখাটো অপারেশন করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। পাশাপাশি দীর্ঘক্ষণ লোডশেডিং থাকায় সময়মতো মিলছেনা জরুরী পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট। বন্ধ রাখতে হচ্ছে দামী যন্ত্রপাতি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৪৯৪টি উপজেলার মধ্যে সদর উপজেলা বাদে বাকিগুলোয় ৩১, ৫০ ও ১০০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে ৪২৬টি। ২০১১ সালের পর গঠিত রাঙ্গাবালি, গুইমাড়া, ডাসার, কর্ণফুলী, ঈদগাঁও, লালমাই, চৌহালি, শায়েস্তাগঞ্জ ও মধ্যনগর এসব উপজেলায় এখনো স্থাপন করা হয়নি কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ।
সিলেটসহ দেশের ৮ বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪৮৩টি জেনারেটর রয়েছে। এর মধ্যে ১৮৭টি জেনারেটর অচল, যার মধ্যে বেশকিছু মেরামতযোগ্য ও বাকিগুলো সম্পূর্ণ বিকল। সিলেট বিভাগের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫৪টি জেনারেটরের মধ্যে অচল রয়েছে ২৮টি।
এদিকে রাজশাহী বিভাগে ৪৯টির মধ্যে অচল ২০টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩১টির মধ্যে অচল ১৩টি, রংপুর বিভাগে ৫৭টির মধ্যে অচল ১৫টি, বরিশাল বিভাগে ২৫টির মধ্যে অচল ১০টি, খুলনা বিভাগে ৫০টির মধ্যে অচল ১০টি, ঢাকা বিভাগে ৭৭টির মধ্যে অচল ২২টি, চট্টগ্রামে ১৪০টি জেনারেটরের মধ্যে অচল রয়েছে ৬৯টি। সব মিলিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় থাকা ৩৮ দশমিক ৭২ শতাংশ জেনারেটর অচল হয়ে পড়েছে। এছাড়া প্রায় ৫০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জেনারেটর নেই।
জানা গেছে, চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কম হওয়ায় দেশে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে কাজ করছে সরকার। এ কারণে জেনারেটর সচল না থাকায় উপজেলা পর্যায়ে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ভোগান্তিতে পড়ছে স্থানীয়রা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় ধরে। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের সময় অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম এড়িয়ে অন্যান্য সেবা দেয়া হয়। এরপরও অপারেশন থিয়েটারে সার্জারি চলাকালে বিদ্যুৎ চলে গেলে আইপিএস (ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার সাপ্লাই) বা টর্চের সাহায্যে কাজ শেষ করতে হচ্ছে। এতে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
জানা গেছে, সারা দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জেনারেটরের প্রায় ৪০ শতাংশ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। অন্যদিকে সচল জেনারেটরগুলোর জন্য মিলছে না প্রয়োজনীয় জ্বালানি বরাদ্দ।
একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনি কনসালট্যান্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কিছুদিন আগে অপারেশন থিয়েটারে সি সেকশন অস্ত্রোপচার চলাকালে হঠাৎই বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়। একই সঙ্গে অচল হাসপাতালের জেনারেটর। আইপিএস দিয়ে অপারেশন থিয়েটারের একটি মাত্র বাতি জ্বালানো যায়। এমন পরিস্থিতিতে অস্ত্রোপচার শেষ করতে বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েন চিকিৎসকরা। কেননা মাঝপথে অস্ত্রোপচার বন্ধ করে দেয়া যায় না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে তাই কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশের মানুষের বাড়তি ব্যয় ৬৩ থেকে ৭০ শতাংশ। সরকারের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রয়োজনীয় সেবা না পেলে এ ব্যয় বাড়তে থাকবে। উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিকল্প নেই স্থানীয়দের। চিকিৎসাসেবা দিতে সেখানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে প্রসূতিদের সেবার জন্য উপজেলা হাসপাতালগুলোই নির্ভরতার জায়গা। এছাড়া সার্জারির জন্য সেখানকার অপরেশন থিয়েটারগুলোকে কার্যকর রাখা জরুরি।
হাসপাতালগুলোতে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে জেনারেটরের বিকল্প নেই।
তবে পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বহু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বিদ্যুৎহীন হয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। বর্তমান সময়ে এ পরিস্থিতি আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। হাসপাতালে জেনারেটর ও প্রয়োজনীয় জ্বালানির বরাদ্দ থাকতে হবে। জরুরি বেশ কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ওপর ন্যস্ত করতে হবে। সেবা নিশ্চিতে তাকে দায় ও দায়িত্ব দুটোই দিতে হবে।
এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় বিদ্যমান জেনারেটরের জন্য নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে জ্বালানির বরাদ্দ। ফলে প্রয়োজন থাকলেও বন্ধ রাখতে হয় জেনারেটর। দেশের অন্তত ৪ জন সিভিল সার্জন জানান, জেলায় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) রেফ্রিজারেটরগুলো চালু রাখতে অব্যাহতভাবে জ্বালানির বরাদ্দ রয়েছে। একই সঙ্গে জেলা সিভিল সার্জন অফিসে পুরো জেলার বিভিন্ন ধরনের টিকা ও জরুরি ওষুধ সংরক্ষণের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (কোল্ডরুম) কক্ষের জেনারেটর চালু রাখার জন্য রয়েছে জ্বালানির বরাদ্দ। এ বরাদ্দ সরকারের রাজস্ব থেকে দেয়া হয়।
সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, সিলেটের ৪ জেলার হাসপাতালগুলোর মধ্যে ৩ জেলা সদর হাসপাতালে জ্বালানি বরাদ্দ রয়েছে। তবে তা খুবই সীমিত। জরুরী প্রয়োজনে কেবল ব্যবহার করা যায়। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও সিলেটের বিয়ানীবাজারে জ্বালানি বরাদ্দ রয়েছে। বাকি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে জ্বালানি তেলের বরাদ্দের সংকট রয়েছে। জেনারেটর ছাড়া অ্যাম্বুলেন্সের জ্বালানি তেল ক্রয় বাবদ বার্ষিক অর্থ বরাদ্দ থাকে। সারা বছর লোডশেডিংয়ের সময় জেনারেটর চালু রাখার জন্য কোথাও ৩০ হাজার, কোথাও ৫০ হাজার আবার কোথাও ১ লাখ টাকার মতো বরাদ্দ রাখা হয়। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী এ বরাদ্দ অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রতুল।
তিনি বলেন, সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় ৪টি সদর হাসপাতাল ও ৩৪ উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। বিভাগের ৩টি নতুন উপজেলা সিলেটের ওসমানীনগর, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে এখনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মিত হয়নি। বিষয়টি চলমান রয়েছে। ৪ টি জেলা সদর হাসপাতালের কোথাও ২টি আবার কোথাও ৪টি পর্যন্ত জেনারেটর রয়েছে। ৪ হাসপাতালের ১২টি জেনারেটরের মধ্যে ৬টি সচল আর ৬টি অচল রয়েছে। এগুলা মেরামত করে চালানো যেতে পারে। এছাড়া ৩৪ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর মধ্যে অধিকাংশ উপজেলায় জেনারেটর নেই, আবার কয়েকটি থাকলেও অচল আছে। সব মিলিয়ে বিভাগের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ৫৪ টি জেনারেটরের মধ্যে সব মিলিয়ে ২৬টির মতো জেনারেটর সচল থাকলেও বরাদ্দের অভাবে অধিকাংশ জেনারেটর বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা) ডা. মো. রিজওয়ানুর রহমান বলেন, নতুন অপারেশন প্ল্যান হওয়ার পর জেনারেটর কেনা হয়নি। এগুলো ২০১৫ সালের আগে কেনা। আবার কিছু কিছু ২০১০ সালের আগে কেনা। জেনারেটরের জ্বালানির খরচ রাজস্ব খাত থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৭ সালে চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচিতে উপজেলা থেকে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) আওতাভুক্ত করা হয়। ২০২০ সালের শেষে এসে সিবিএইচসি দুই ভাগ হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্যসেবাকে আলাদা করা হয়েছে। আগামী সেক্টর কর্মসূচিতে জেনারেটরের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
শেয়ার করুন