লোডশেডিং: ১০ দিন সময় চাইলেন প্রতিমন্ত্রী

জাতীয়

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে তৈরি হওয়া মন্দাভাব ঠেকাতে সরকারের সাশ্রয়ী নীতির অংশ হিসেবে সূচি করে লোডশেডিং দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তা ঠিকভাবে সমন্বয় করতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ।

শহর অঞ্চলে সূচি কিছুটা ঠিক থাকলেও গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের কারণে ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। এক ঘণ্টার কথা বলা হলেও দেশের কোথাও কোথাও লোডশেডিং হচ্ছে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা।

বিদ্যুৎ বিতরণে এ ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ জন্য ৭ থেকে ১০ দিন সময় চেয়েছেন তিনি।

প্রতিমন্ত্রী বলছেন, এ সময়কালে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে লোডশেডিং কীভাবে আরও কমিয়ে সূচি মেনে চলা যায়, সে জন্য নেয়া হবে নতুন পরিকল্পনা।

ঢাকার গুলশানে নিজ বাসভবনে শুক্রবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘আমি বলছি যে এক সপ্তাহ দেখব। আমাদের ডেটাটা আমরা এক সপ্তাহ দেখতে চাই। কোনো কোনো জায়গায় এক ঘণ্টার বেশি হচ্ছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি। একটা ফিডার বন্ধ করলাম, সেখান থেকে বিদ্যুৎ আসতে আসতে দুই-তিন ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় আমি লক্ষ্য করেছি চার ঘণ্টা হয়েছে। আমার নিজের এলাকাতেও হয়েছে। আমরা এগুলো দেখার জন্য কিন্তু এক সপ্তাহ সময় নিয়েছি।’

সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়ার কথাও জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহ সময় নিয়ে আমরা দেখছি, আমাদের কতটুকু লোডশেড করা দরকার। কীভাবে এটাকে আমরা আরেকটু কমিয়ে নিয়ে আসব। ১০টা দিন হলে পরে আস্তে আস্তে ঠিক করে নিয়ে আসব, বেটারের দিকে যাবে।’

প্রতিমন্ত্রী জানান, দেশে যে ডিজেল আমদানি করা হয়, তার মাত্র ১০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। সেই ১০ ভাগ ডিজেল বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার না করায় প্রতিদিন এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

ডিজেল সাশ্রয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে, তা অঙ্ক কষে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথাও জানান নসরুল।

তিনি বলেন, ‘দেখতে চাই আগামী এক সপ্তাহ, ১০ দিন কী হলো। এক হাজার মেগাওয়াট বন্ধ করলাম, ডিজেল সেভ করলাম, এতে পরিস্থিতিটা কী হলো? আমি যদি লোডশেড না করতাম ইকনোমিক্যালি আমাদের কতটা পক্ষে আসত, আর লোডশেড করে আমার কতটুকু লস হলো। বিষয়টি আমি এক সপ্তাহ দেখতে চাচ্ছিলাম। ওই ক্যালকুলেশনের মধ্যে আছি। না হলে করব না।’

নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) ইতোমধ্যে ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ফেলছে ডিজেল কিনতে গিয়ে। ফলে ডলারের ওপর চাপ বেড়েছে। এটা তো বুঝতে হবে। কারণ বিপিসি তার প্রাইস সমন্বয় করেনি। ইন্ডিয়া বহু আগে করে ফেলেছে। আমরা যাইনি।’

পিক আওয়ারে শিল্প উৎপাদনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যায় বলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি ওঠানামা করার কথা জানান প্রতিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘পিক আওয়ারে ইন্ডাস্ট্রির গ্যাসের ডিমান্ড বেড়ে যায়। ওরা সন্ধ্যাবেলা চালায়। একটা সপ্তাহ আমরা দেখতেছি। অ্যাভারেজে কত হচ্ছে, কোনো কোনো সময় দুই হাজার হচ্ছে, কোনো কোনো সময় দুই হাজার ২০০ হচ্ছে, আবার কোনো কোনো সময় দেড় হাজার হচ্ছে।

‘এই সপ্তাহের রেজাল্ট পেলে পরে নেক্সট সপ্তাহে আরেকটা প্ল্যান করব। আমাদের টাইমিং শিডিউলটা ঠিক করব। টাইমিং ঠিক রাখতে পারছি কি না। শহরে আমরা পারতেছি; গ্রামে আমরা পারতেছি না। কোনো কোনো গ্রামে তিন, চার, পাঁচ ঘণ্টাও হয়ে যাচ্ছে। ওখানে আমরা কী মেজার নেব, এক সপ্তাহ পরে আমরা চিন্তাভাবনা করব।’

গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় লোডশেডিং কম। কোনো কোনো এলাকায় বেশি ভোগান্তি হচ্ছে বলে সাধারণ মানুষ যে অভিযোগ করেছেন, তা অবশ্য মানছেন না প্রতিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘কোনো ভিআইপি বা অ-ভিআইপি এলাকা নির্দিষ্ট করা নেই। একটা ফিডার বন্ধ করলে ওখানে ভিআইপি পারসন যাদেরকে বলি, তারাও আছেন, সাধারণও আছেন। এমন কিছু নেই।’

কূটনৈতিকপাড়া থেকে বিষয়টি বিবেচনার একটি অনুরোধ প্রতিমন্ত্রীর কাছে এসেছে বলেও জানান তিনি।

নসরুল হামিদ বলেন, ‘ডিপ্লোম্যাটিক জোন থেকে অনুরোধ করা হয়েছে যেন একটু লক্ষ রাখা হয়। তারা কিন্তু বলেনি, লোডশেডিং বন্ধ করে দিতে হবে। তারা লক্ষ রাখতে বলেছেন, বিষয়টি আমরা লক্ষ রাখছি।’

বিদ্যুতের চাহিদা, উৎপাদন, ঘাটতি নিয়ে সবিস্তারে কথা বলেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘আমি খুব সোজা একটা হিসাব করে দিই বিদ্যুতের অবস্থাটা কী। আমাদের বিদ্যুতের অবস্থা হলো গ্যাস থেকে আমরা ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতে পারি। সেখানে কয়লা আছে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনছি। ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ আনছি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি আছে।

‘আমাদের এই যে তেল আছে, তেল থেকে প্রায় আমরা ছয় হাজার মেগাওয়াট দিতে পারি। ছয় থেকে সাত হাজার ম্যাক্সিমাম। আর বাকি বিদ্যুৎ তিন হাজারের মতো আমরা ধরে রাখতে পারি। সব মিলিয়ে হলো ১৮ হাজার। এর সঙ্গে যদি আমি ক্যাপটিভ পাওয়ার যোগ করি তাহলে আমার সব মিলিয়ে হবে ২৫ হাজারের মতো ‘

তিনি জানান, মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১০ শতাংশ সার্ভিসিংয়ের মধ্যে থাকে, এটা ধরে নিয়ে হিসাব করা হয়।

নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমরা যদি ধরে নিই ১০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র সার্ভিসিংয়ের মধ্যে থাকে, ফলে এক হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার মেগাওয়াটের মতো এখান থেকে চলে যায়। আর ১০ শতাংশ আমাকে হাতে রাখতে হয়। একটা কেন্দ্রে যদি ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকে, তাহলে আমরা নিতে পারি ৮০ মেগাওয়াট। এটা ব্যালেন্স করার জন্য। আর ১০ পার্সেন্ট যদি বাদ দিই, আরও দুই হাজার চলে গেল। ১৫ হাজারের মতো আমার হাতে ক্যাপাসিটি আছে। ১৫ হাজার চালাতে গেলে আমার যে পরিমাণ গ্যাস লাগবে, যে পরিমাণ আমার তেল লাগবে, সেই ক্যাপাসিটিতে তেল যদি আমি পাই, তাহলে আমি খুব নির্বিঘ্নে দিতে পারি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন ডিমান্ড আছে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ এর মতো। এটা ডিমান্ড। এর বেশি ওঠে আমি দেখলাম না। ১৪ হাজার ৫০০ যখন বলতেছি, এটা সন্ধ্যাবেলায়। পিক আওয়ারের সময়। আর দিনের বেলায় ১১ থেকে সাড়ে ১২ হাজার। আগামী বছর হয়তো এটা আরও এক হাজার বাড়বে।’

শুধু ডিজেলের পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ডিজেলে পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে আমাদের এক হাজার মেগাওয়াট মাত্র। ২৫ হাজারের মধ্যে এক হাজার মাত্র তেলভিত্তিক ডিজেল দিয়ে চলে। সেটা আমরা বন্ধ করে দিছি। কারণ ডিজেলের দাম অনেক বেড়ে গেছে।

‘ডিজেল যে পরিমাণ ইমপোর্ট করে বাংলাদেশ, তার মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। তাই আমাদের জায়গা থেকে বলছি যে ১০ পারসেন্ট যদি কাটঅফ করি, দেখি কী হয়।’

বাকি ৯০ ভাগ ডিজেল পরিবহন ও সেচ কাজে ব্যবহার হয় বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি এখানেও ১০ শতাংশ ব্যবহার কমাতে পারি, আমি বলছি না কোনো কিছু বন্ধ করে দিয়ে, আমি বলছি যদি সাশ্রয় করি। আমার এখানে পাঁচটা লাইটা আছে, দুটো বন্ধ করে যদি আমি চালাতে পারি, তাহলে ফাইন। আমি যদি সাশ্রয় করতে পারি, আননেসেসারি ট্রিপ বন্ধ করে দিয়ে তাহলে ২০ পারসেন্ট ডিজেল ইমপোর্টের যে ডলারটা, সেটা সেভ হয়।’

বিদ্যুৎ খাতে গত ১৩ বছরের সরকারের এত সাফল্যের দাবির পরও লোডশেডিং ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের যথেষ্ট অর্থ আছে, কিন্তু ডলারের ওপর যাতে চাপ সৃষ্টি না হয় আগামী কয়েক মাস, সে কারণে একটা প্রিকশন (পূর্ব সতর্কতা) নেয়া হয়েছে, আমাদের জ্বালানি এবং বিদ্যুতের ক্ষেত্র দিয়ে।’

বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে সেটা শিল্প উৎপাদনে দেয়া হচ্ছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করছি, ইন্ডাস্ট্রিতে দিলে এটার রিটার্ন বেটার।’

সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমাণ দেড় হাজার মেগাওয়াটে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানান নসরুল হামিদ।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে দেখা যাচ্ছে দেড় হাজারের মতো লোডশেড চলতেছে। কোনো কোনো সময় হয়তো, গ্যাস যদি বেশি টানা হয় ইন্ডাস্ট্রিতে তখন ৪০০-৫০০ লোড বেশি বেড়ে যায়। এ রকম একটা পরিস্থিতি লক্ষ্য করতেছি গত দুই-তিন দিন যাবৎ।’

তারপরেও চলমান এই অবস্থাকে সাময়িক বলছেন প্রতিমন্ত্রী। কয়লাভিত্তিক রামপাল, আদানি এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন শুরু করার ওপর আস্থা রাখছেন তিনি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘অল্টারনেটিভ ফুয়েলের ক্যাপাসিটি আসতেছে। এ জন্য সাময়িক বলছি। সামনের সিজনে ডিমান্ড লোডাউন হবে। সো আমি ওটা দিয়ে কাভারআপ করতে পারব।’

বিশ্ববাজারে জ্বালানির যে ঊর্ধ্বগতি, তা সহসা কমবে বলে মনে করছেন না নসরুল হামিদ।

তিনি বলেন, ‘তেল এবং গ্যাসের ব্যাপার কিন্তু সাময়িক না। এই যুদ্ধ যদি আরও কন্টিনিউ করে, ইউরোপ-রাশা থেকে সরে এসে অন্যদিকে যাবে, আল্টিমেটলি বড় ক্রাইসিস তৈরি হবে, যদি তারা কোনো সল্যুশনের দিকে না যায়।’

আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কয়েকটা মাস যদি আমরা চিন্তা করে ব্যবহার করি, ফরেইন কারেন্সির রিজার্ভের কথা চিন্তা করে যদি করি, আমাদের সমস্যা হওয়ার কথা না।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *