সিলেটে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কা

সিলেট

ভৌগোলিক অবস্থান থেকে প্রতিবছর পাঁচ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বদিকে সরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশ যে সাবডাকশন জোনে অবস্থিত তার আশপাশে তিনটি টেকটোনিক পেস্নট সক্রিয়। উত্তরে ইউরেশিয়ান পেস্নট ও পূর্বে বার্মার মাইক্রো পেস্নটের অবস্থান। ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান পেস্নটের ওপর দেশের অবস্থান হলেও ওই দু’টি পেস্নটের সঙ্গে সংযুক্তি রয়েছে। ভূ-তাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, বার্মিজ মাইক্রো পেস্নট এগিয়ে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান পেস্নটের দিকে। আর ইন্ডিয়ান পেস্নট এগোচ্ছে ইউরেশিয়ান পেস্নটের দিকে। টেকটোনিক পেস্নট তিনটি প্রতি বছর পাঁচ সেন্টিমিটার বা ৫০ মিলিমিটার সরছে। ফলে বছরে পাঁচ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বদিকে সরছে। এ ছাড়া পেস্নট বাউন্ডারি লাইন বা দুটি পেস্নটের সংযোগস্থলে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষের ফলে উচ্চতা বাড়ছে হিমালয়ের। পৃথিবীর উপরিতলে থাকা পেস্নটগুলোর ক্রমাগত নড়াচড়ার কারণে অস্বাভাবিক চাপ বাড়ছে এ অঞ্চলে, যা বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভূ-বিজ্ঞানের মতে, পৃথিবী বেশকিছু টেকটোনিক পেস্নটের ওপরে অবস্থিত। যেমন- ইউরেশিয়ান পেস্নট ইউরোপজুড়ে বিস্তৃত, এটি নেপাল পর্যন্ত চলে এসেছে। ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান পেস্নট অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ ও তৎসংলগ্ন মহাসাগর হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় উপমহাদেশ ও তৎসংলগ্ন জলভাগ পর্যন্ত প্রসারিত। এসব পেস্নট প্রতিনিয়ত নড়াচড়া করছে। ফলে পুরো পৃথিবীই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।

দেশে চলতি বছর এখন পর্যন্ত (২ অক্টোবর) ১১টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। এতে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ধরনের ভূমিকম্পের আভাস এগুলো। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভারতের মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমারের পার্বত্য এলাকাও রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। কিশোরগঞ্জের হাওড় দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকের এলাকাটি দুটি টেকটোনিক পেস্নটের সংযোগস্থল। এ দুটি পেস্নটের মধ্যে পূর্বদিকে অবস্থিত বার্মা পেস্নট, পশ্চিমে অবস্থিত ইন্ডিয়ান পেস্নট। এর সংযোগস্থলের

ওপরের ভাগটি অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মণিপুর, মিজোরাম পর্যন্ত অঞ্চলটি ‌‘লকড’ হয়ে আছে। অর্থাৎ এখানে প্রচুর শক্তি জমা হয়ে আছে।

এ বছরের শুরুতে ভূমিকম্পের ভয়াবহ তান্ডবের শিকার হয় তুরস্ক-সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সেখানে মারা যান প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। লাখ লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। গত ৫ ফেব্রম্নয়ারি সেখানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। পরে বেশ কয়েক দফা সেখানে ভূকম্পন অনুভূত হয়।

এরপর চলতি মাসের ৭ তারিখে আফগানিস্তান অঞ্চলে সাতটি ভূমিকম্পে আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশটির হেরাত থেকে ২১.৭ মাইল উত্তর-উত্তর-পশ্চিমে ৫.৯ মাত্রার, জিন্দাজান থেকে ২০.৫ মাইল উত্তর-উত্তর-পূবে ৬.৩ মাত্রার এবং হেরাত শহর ২৬ মাইল পশ্চিমে জিন্দাজানের ১৮ মাইল উত্তর-উত্তর-পূর্বে আরেকটি ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।

এরপর ১১ অক্টোবর দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে আবারো ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। হেরাত শহরের ২৯ কিলোমিটার উত্তরে এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে ছিল এর উৎপত্তিস্থল। এ ঘটনার ১০ মিনিট পর একই এলাকায় ৫ মাত্রার আরেকটি আফটার শক আঘাত হানে।

এছাড়া চলতি মাসের ৩ তারিখে নেপালে ৫৪ মিনিটে পরপর চারবার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর একটির মাত্রা ছিল ৬.২। তার জেরে কেঁপে ওঠে দিলিস্নসহ উত্তর ভারতের বেশ কিছু অংশ। দ্বিতীয় ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.২। এরপর ৩.৮ মাত্রার আরো একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। সবশেষ আঘাত হানে ৩.১ মাত্রার ভূমিকম্প।

আবহাওয়াবিদ ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মো. মমিনুল ইসলাম সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘পৃথিবীর মুভমেন্ট তিনটি ক্রাইটেরিয়ায় সম্পন্ন হচ্ছে। প্রথমটি হলো- কনভারজেন্ট মুভমেন্ট, অর্থাৎ দুটি পেস্নট একই দিকে পরিচালিত হয়ে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হলো- একটি পেস্নট একদিকে এবং অপরটি বিপরীত দিকে মুভ করছে। এটি ডাইভারজেন্ট মুভমেন্ট। তৃতীয়টি হলো- ল্যাটেরাল মুভমেন্ট, অর্থাৎ যদি কোনো একটি পেস্নট স্টাবল থাকে এবং অপরটি মুভ করে। এ তিন ক্রাইটেরিয়ায় পৃথিবী মুভ করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নেপালে যেমন ইউরেশিয়ান পেস্নট আর আমাদের ইন্ডিয়ান পেস্নট (বাংলাদেশ যে পেস্নটে অবস্থান করছে)। দুটি পেস্নটের কনভারজেন্ট মুভমেন্ট বিদ্যমান। কনভারজেন্ট মুভমেন্ট হওয়ায় একটি পেস্নট আরেকটি পেস্নটের দিকে মুভ করছে এবং একটি পেস্নট গ্রাজুয়ালি রাইজিং করছে। অর্থাৎ হিমালয়ের যে উচ্চতা, যেটি গত বছর যা ছিল তার চেয়ে একটু হলেও বেড়েছে। এজন্য যখন পেস্নট মুভ করে এবং কোনো কারণে যদি ওখানে মুভমেন্ট কম হয় বা মুভমেন্ট না হয় তখনই সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।’

ভূতত্ত্ববিদ ও খ্যাতনামা ভূ-বিজ্ঞানী উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর সৈয়দ হুমায়ুন আখতারের মতে, ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুযায়ী বাংলাদেশ তিনটি পেস্নটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। বাংলাদেশের উত্তরে ইউরেশিয়ান পেস্নট, পশ্চিমে ইন্ডিয়ান পেস্নট এবং পূর্বে হচ্ছে বার্মা পেস্নট। ইন্ডিয়ান ও বার্মা পেস্নটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। সেটি হচ্ছে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের হাওড় হয়ে মেঘনা নদীর পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। যদি সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওড়টা দেখেন, তাহলে দেখবেন যে এটি উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত এবং মেঘনা নদীতে এসে পড়েছে। এটি দিয়ে যদি একটি কাল্পনিক রেখা টানেন তাহলে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মেঘনা নদী হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান দিয়ে বার্মা ও ইন্ডিয়ান পেস্নটের সংযোগ ঘটেছে। অন্যদিকে, এটির পূর্বে বার্মা পেস্নট এবং পশ্চিমে ইন্ডিয়ান পেস্নট অবস্থিত। ইন্ডিয়ান পেস্নট সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও মেঘনা নদীর লাইন বরাবর বার্মা থেকে নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। যখন একটি পেস্নট আরেকটি পেস্নটের নিচে তলিয়ে যায় তখন আমরা বলি সাবডাকশন জোন। এ সাবডাকশন জোন সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন পর্যন্ত বিস্তৃত।

তিনি সম্প্রতি একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘পৃথিবীর যত বড় ভূমিকম্প সবগুলোই সাবডাকশন জোনে সংঘটিত হয়েছে। জাপান, চিলি, আলাস্কায় বড় বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। সেখানে যে ভূতাত্ত্বিক কাঠামো (সাবডাকশন জোন), একই কাঠামো আমাদের বাংলাদেশে অবস্থিত। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের সাবডাকশন জোন এবং এর আশপাশের অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। সেই ভূমিকম্পগুলো ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, নদী-নালার গতিপথের পরিবর্তন এনেছে। ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়।’

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বড় ভূমিকম্প ভূপৃষ্ঠকে কোথাও উঁচু করে দেয়, আবার কোথাও নিচু করে দেয়। যেমন- চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল সৃষ্ট হয়েছে ভূমিকম্পের মাধ্যমে। দুটি পেস্নটের পরস্পরমুখী সংঘর্ষ হলেই পাহাড়ের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া জনবসতিও স্থানান্তর করে ভূমিকম্প। ১৭৬২ সালে ভূমিকম্পের আগে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ডের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এটি ছিল ডুবন্ত দ্বীপ। ভাটার সময় কিছুটা জেগে উঠত এবং জোয়ারে ডুবে যেত। ৮.৫ মাত্রারও বেশি ওই ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার ওপরে উঠে আসে। ওই একই ভূমিকম্পে সীতাকুন্ডের পাহাড়ে কাদা-বালির উৎগীরণ হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এগুলো আছে। সেই ভূমিকম্পে মিয়ানমারের চিদুয়া আইল্যান্ডও ৬ মিটার ওপরে উঠে আসে।’

২০১৬ সালে প্রকাশিত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণা অনুযায়ী, সিলেট থেকে কক্সবাজার অঞ্চলে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে। যে কোনো সময় এ শক্তি বের হয়ে আসতে পারে। এ শক্তি একবারে বের হতে পারে আবার ধীরে ধীরেও বের হতে পারে। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন সাবডাকশন জোনে যেসব ভূমিকম্প হয়েছে, সেগুলো থেকে ৬৫ থেকে ৮০ ভাগ শক্তি একবারে বের হয়েছে। বাংলাদেশেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ৮০০ থেকে এক হাজার বছর আগে কুমিলস্নার ময়নামতিতে ভূমিকম্পের মাধ্যমে পেস্নটগুলো জমাটবাঁধা শক্তি বের করেছিল। এরপরই নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে এ অবস্থায় এসেছে। তার মানে, গত এক হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হতে হতে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়েছে। এ শক্তিই যে কোনো সময় বের হয়ে আসতে পারে। ভূমিকম্পগুলো হয়েছে সাবডাকশন জোনের মধ্যে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে ঢাকা থেকে দূরে ভূমিকম্পের উৎস হলেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা। এখানে যদি ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ঢাকা মৃতু্যপুরীতে পরিণত হতে পারে। পরিকল্পনাহীন নগরায়নের কারণে ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাবে। এজন্য পরিকল্পনা করে ঢাকার ওপর চাপ কমিয়ে দেশের জনবসতি পশ্চিমাঞ্চলের দিকে নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে রেজিলিয়েন্স সোসাইটি গঠনের মাধ্যমে কার্যকর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া এবং তার বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে মানুষের মধ্যে ভূমিকম্পের জন্য সচেতনতা তৈরির কাজটি অব্যাহত রাখতে হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *