বাংলাদেশের সিলেট ও মৌলভীবাজারের সড়ক ব্যবহার করে ত্রিপুরা এবং মণিপুর রাজ্যে জ্বালানি তেল ও তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) পাঠাতে চায় ভারত। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হওয়ায় এ সুবিধা চেয়েছে দেশটি। তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এ-সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের দিন থেকে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আপত্কালীন এ সুবিধা দেয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ। এ সিদ্ধান্ত ভারত সরকারকেও জানানো হয়েছে। তবে ভারতীয় হাইকমিশন সুবিধার মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত করার অনুরোধ জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, গত ২২ মে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে জ্বালানি সরবরাহের সুবিধা চেয়ে অনুরোধ জানায় ভারত। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে। সবশেষ গত বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় জানানো হয়, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর সমঝোতা স্মারকের খসড়া তৈরি করে তা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মহাসড়ক বিভাগে পাঠিয়েছে। এরপর সম্প্রতি সড়ক পরিবহন বিভাগ খসড়াটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এরপর মতামত নেয়ার জন্য খসড়াটি ভারত সরকারের কাছে পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সমঝোতা স্মারকের সব বিষয়ে সম্মত হলেও সুবিধা দেয়ার বিষয়টি আগামী ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করতে অনুরোধ জানিয়েছে ভারতীয় হাইকমিশন।
তবে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় উপস্থিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের প্রতিনিধিরা ভারতকে সুবিধা দেয়ার সময়সীমা ২০২৩ সাল পর্যন্ত না বাড়ানোর পক্ষে মত দেন। তারা বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট সংকটের বিষয়টি দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আলোকে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এর আগে ২০১৬ সালেও ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনকে (আইওসি) বাংলাদেশের আংশিক সড়কপথ ব্যবহার করে ত্রিপুরায় জ্বালানি তেল ও এলপিজি পরিবহনের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সে সময় দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের সময়কাল ছিল ৪৪ দিন। এবারের সমঝোতা স্মারকটি যেহেতু স্থায়ী নয়, সেহেতু আপত্কালীন হিসেবে তিন-চার মাস এ সুবিধা দেয়ার পক্ষে মত দেন উপস্থিত প্রতিনিধিরা।
ভারত ও বাংলাদেশের আবহাওয়াগত সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করে সভায় উপস্থিত সদস্যরা বলেন, সাধারণত অক্টোবরের পর বন্যা পরিস্থিতি থাকে না। এছাড়া নভেম্বরের পর থেকে শীত মৌসুম শুরু হয়। তাছাড়া আগামী বছরও যে ভারতের ওই অঞ্চলে বন্যা হবে সে কথা এখনই বলা সম্ভব নয়। তাই আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সমঝোতা স্মারকের সময়সীমা নির্ধারণ করাই যৌক্তিক। এছাড়া সভায় বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও এর ব্যয় বিষয়েও আলোচনা হয়।
আলোচনার পর সভায় সিদ্ধান্ত হয়, জ্বালানি তেল ও তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) পরিবহনের জন্য সাময়িক পণ্য পরিবহন সুবিধা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের দিন থেকে আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে। অন্যদিকে ভারতীয় পণ্যের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুলিশি নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ব্যয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সংস্থান করা হবে। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ এ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পরিপত্র জারি করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, খুব শিগগির এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকটি সই হবে। কী শর্তে ও কতদিনের জন্য ভারতীয় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহার করে জ্বালানি পরিবহন করতে পারবে, তা নির্ধারিত থাকবে সেখানে।
জানা গেছে, এ বছর বন্যা ও ভূমিধসে আসামের সড়ক ও রেলপথ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজধানী গুয়াহাটি থেকে রাজ্যটির ডিমাহাসও জেলা ও বরাক উপত্যকা হয়ে জ্বালানি তেল এবং গ্যাস ত্রিপুরা ও মণিপুর পাঠায় দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আইওসি। একমাত্র রেলপথটি বিধ্বস্ত হওয়ায় গুয়াহাটি থেকে মেঘালয় ঘুরে ত্রিপুরা, মণিপুর ও মিজোরামে জ্বালানি পাঠাতে হচ্ছে। এতে করে মাসিক পরিবহন ব্যয় পৌনে ৫ কোটি রুপি থেকে বেড়ে সাড়ে ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। সময়ও লাগছে দ্বিগুণ। দূরত্ব বেড়েছে ১৭৩ কিলোমিটার।
পাহাড়ি বিপত্সংকুল পথ এড়াতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে জ্বালানি সরবরাহের সুবিধা চেয়ে অনুরোধ জানায় ভারত। দেশটির প্রস্তাব অনুযায়ী, গুয়াহাটির জোয়াই ও মেঘালয়ের ডাউকি থেকে বাংলাদেশের সিলেটের তামাবিল হয়ে ঢুকবে তেল ও এলপিজিবাহী গাড়ি। সিলেট থেকে মৌলভীবাজারের চাতলাপুর চেকপোস্ট হয়ে ত্রিপুরার কৈলাশহরে যাবে। জ্বালানি পরিবহন শেষে একই পথে ভারতে ফিরে যাবে।
আসামের বেতকুচি জ্বালানি ডিপো থেকে ত্রিপুরার ধর্মনগর ডিপোর দূরত্ব ৩৭৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে পড়ছে ১৩৭ কিলোমিটার পথ। ১৫ টন জ্বালানি তেলবাহী ভারতীয় ট্যাংকার এ পথ ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা টোল দেবে। খালি অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সময়ও একই পরিমাণ টোল দিতে হবে ভারতীয় গাড়িকে।
এর আগে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বন্যা-পরবর্তী সময়ে আসাম থেকে বাংলাদেশ হয়ে ত্রিপুরায় জ্বালানি তেল পাঠিয়েছিল ভারত। তখন প্রতি টন জ্বালানির জন্য বাংলাদেশকে কিলোমিটারে ১ টাকা ২০ পয়সা টোল দিয়েছিল। এবার ১ টাকা ৮৫ পয়সা টোল প্রস্তাব করেছে সওজ। চট্টগ্রাম, আশুগঞ্জ বন্দর থেকে (ট্রান্সশিপমেন্ট) পণ্য নিয়ে আসাম ও ত্রিপুরায় যাওয়া ট্রাককেও একই পরিমাণ টোল দিতে হয়।
শেয়ার করুন