সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন যতো ঘনিয়ে আসছে, ততোই বাড়ছে চমক। শুরুতেই দলের মনোনয়ন পেয়ে চমক দেখালেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এই নেতা দলের ১০ প্রার্থীকে পিছনে ফেলে নৌকা প্রতীক লাভ করতে সমর্থ হন। আর বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এখনও গেম খেলে যাচ্ছেন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায়। তিনি ‘রেড’ ও ‘গ্রিন’ সিগন্যাল ঘোষণাতেই আটকে আছেন। এমনকি যুক্তরাজ্যে নিজ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করার পরও ঘোরে রেখেছেন ভোটারদের। এদিকে প্রার্থী হতে ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন বিএনপির সাবেক দুই ডাকসাইটে নেতা। এরমধ্যে বদরুজ্জামান সেলিম ‘যদি’ অপশন রেখে নিজের প্রার্থীতা বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তবে অপর নেতা সামসুজ্জামান জামান কিছু না বললেও তাঁর অনুসারীরা বলছেন, প্রার্থীতা বিষয়ে ভোটারদের চাপ রয়েছে। তাদের অনুরোধ ও সমর্থনকে সম্মান জানাতে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রার্থী হতেও পারেন। মোট কথা- সিসিক নির্বাচনে সহজ হিসেব এখন জটিল সমীকরণে।
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী : সিলেট-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হতে বেশ আগ থেকেই প্রচারণা চালান আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতেই একটি গ্রিন সিগন্যালে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ২২ জানুয়ারি দেশে আসেন আনোয়ারুজ্জামান। এ সময় ওসমানী বিমানবন্দর থেকে মোটর শোভাযাত্রা করে তাকে নিয়ে আসা হয় নগরীতে। দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং হযরত শাহজালাল (র.) মাজার জিয়ারত করেন আনোয়ারুজ্জান চৌধুরী। এ সময় দলীয় নেতাকর্মী এবং গণমাধ্যম কর্মীদের তিনি জানান, দলীয় প্রধানের নির্দেশেই সিলেট এসেছি। তিনি নগরবাসীর জন্য আমাকে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এতেই তার মনোনয়নপ্রাপ্তির বিষয়টি অনেকটাই খোলাসা হয়ে যায়। তখন থেকেই বিরামহীন চষে বেড়াচ্ছেন নগরের অধিকাংশ ওয়ার্ড। অতি অল্প দিনে জনমত জরিপে ভোটারদের কাছে তিনি একটি শক্তিশালী অবস্থানও তৈরি করে নেন। তবে দলের অপর মেয়র প্রার্থীরা শুরুতে আনোয়ারুজ্জামানের প্রার্থীতা ঘোষণার বিষয়টি সহজভাবে মেনে না নিলেও জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের একটি বৃহৎ অংশসহ সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পাশে ছিলেন আনোয়ারুজ্জামানের। তবে শেষ সময়ে এসেও সকলেই অভিনন্দিত করেছেন দলের মনোনীত প্রার্থীকে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভাজন ভুলে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করলে বিজয়ী হওয়া সহজ হবে।
আরিফুল হক চৌধুরী : সিলেট পৌরসভাকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা করা হয় ২০০২ সালে। প্রথম নির্বাচন হয় চারদলীয় জোট সরকার আমলে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। তিনি পৌরসভা থাকাকালে চেয়ারম্যান থেকে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। পরে ২০০৮ সালে কারাগারে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয়বার বিজয়ী হয়েছিলেন কামরান। তৃতীয় নির্বাচন হয় ২০১৩ সালের ১৫ জুন। এ নির্বাচনে কামরানের সঙ্গে মেয়র পদে ওয়ার্ড কমিশনার থেকে মেয়র পদে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বিএনপি– সমর্থিত প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। ‘পরিবর্তন’ আওয়াজ তুলে আরিফুল হক চৌধুরী ৩৫ হাজার ১০০ ভোটের ব্যবধানে কামারানকে হারিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে আরিফুল হক পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭ হাজার ৩৩০ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বদরউদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছেন ৭২ হাজার ২৩০ ভোট। তাঁদের ভোটের ব্যবধান ছিল ৩৫ হাজার ১০০। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। ওই নির্বাচনে আরিফুলের প্রাপ্ত ভোট ৯২ হাজার ৫৯৩ ভোট। অন্যদিকে বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের প্রাপ্ত ভোট ৮৬ হাজার ৩৯৭ ভোট। এবার তৃতীয় বারের মতো মেয়র পদে প্রার্থী হচ্ছেন-এমনটি শোনা গেলে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এখনও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন নি।
একটি সূত্র জানিয়েছে, আরিফুল নির্বাচনে অংশ নিলে বদরুজ্জামান সেলিমও অংশ নিতে চান নির্বাচনে। আরিফুল ও বদরুজ্জামান একই দলের নেতা হলেও স্থানীয়ভাবে তাঁদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদিকে বিএনপি থেকে পদত্যাগ কারী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা সামসুজ্জামান জামানও প্রার্থী হচ্ছেন-এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে এই দুইজন প্রার্থী হলে বেকায়দায় পড়তে পারেন আরিফুল হক চৌধুরী।
অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান : ন’য়ের দশকে ছাত্ররাজনীতিতে মাঠ কাঁপানো নেতা সামসুজ্জামান জামান। মেধা,যোগ্যতা এবং আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নেন বিএনপি’র রাজনীতিতে। পরবর্তীতে অভিভাবক সংগঠন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে যুক্ত হন স্বেচ্ছা সেবকদলের রাজনীতিতে। দূরদর্শী এই নেতার হাত ধরেই সিলেটে প্রতিষ্ঠা পায় স্বেচ্ছাসেবক দল। আর স্বেচ্ছাসেবক দলই হয়ে উঠে সিলেটে আওয়ামী লীগের আতঙ্ক। সিলেট জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট সামসুজ্জামান কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সামসুজ্জামানের ঘোষণার পর তাঁর অনুসারী বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের জেলা ও মহানগর পর্যায়ের প্রায় তিন শ পদধারী নেতা কয়েক দিনের ব্যবধানে পদত্যাগ করেন।
সিসিক নির্বাচনে প্রার্থীতা বিষয়ে সামসুজ্জামানের অনুসারীরা বলছেন, বিএনপি থেকে পদত্যাগ করলেও দল ও দলের বাইরে সামসুজ্জামানের এখনো একটা বিশাল কর্মিবাহিনী রয়েছে। সম্প্রতি একাধিকবার তিনি তাঁর সমর্থক কর্মীদের নিয়ে নানা ধরনের সভাও করেছেন।
উল্লেখ্য ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সামসুজ্জামান মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় হন। এখন নগরে তাঁর অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হয়েছে বলে মনে করেন সামসুজ্জামানের সমর্থকেরা।
বদরুজ্জামান সেলিম : ২০১৮ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন তৎকালীন সিলেট মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে তখন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হন। যদিও শেষ পর্যন্ত দলের অনুরোধে বিএনপির দলীয় প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর সমর্থনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে বদরুজ্জামান অনেকটাই ‘উধাও’ হয়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান। বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, একই দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে বদরুজ্জামানের দূরত্ব আছে। তাই, যদি কোনো কারণে মত পাল্টে বিএনপি নির্বাচনে আসে, তাহলে বদরুজ্জামানও বিএনপির দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। যদি আরিফুল দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন, তাহলে বদরুজ্জামান স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন।
এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বদরুজ্জামান সেলিমের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। তবে, বদরুজ্জামান সেলিমের ঘনিষ্ট সূত্র জানায়, ঈদের পরপরই দেশে ফিরে পরিস্থিতি যাচাই –বাছাই করে তিনি সিদ্বান্ত গ্রহণ করবেন। ।
নির্বাচনের বিষয়ে সামসুজ্জামান জামান জানান, ‘এরকম কোনো প্রস্তুতি নেই। তবে, দীর্ঘদিন মানুষের কল্যাণে ত্যাগের রাজনীতি করেছি। এর ফলে নগরের শুভাকাঙ্খিদের অনেকেই যোগাযোগ রাখছেন। চাপেও রাখছেন। তাছাড়া, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গনের নেতাসহ সাধারণ মানুষের প্রেশার (চাপ) আছে।’ তিনি বলেন, জণগণের কল্যাণে যেহেতু রাজনীতির মাঠে ছিলাম, সেক্ষেত্রে সময় এবং সুযোগে তাদের ভালোবাসা ও সম্মানের প্রতিদান দিতে নিজেকে সঁপে দিতে কার্পণ্য করবো না।
এ ব্যাপারে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমি সিলেটের ছেলে। এ শহরে ছাত্ররাজনীতি করেই আমার বেড়ে উঠা। সুতরাং সিলেট থেকে কখনোই আমি বিচ্ছিন্ন নই। তাছাড়া দলের মনোনয়ন পান নি এমন নেতাদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে।
তিনি বলেন, টানা দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেই নগরভবনে। এই বিষয়টি আমলে নিয়ে সিলেট, দল এমনকি উন্নয়নের স্বার্থে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রী যে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখছেন, একইভাবে আমি এ সিলেট নগরকে স্মার্ট নগরে পরিণত করতে চাই। পরিকল্পিত উন্নয়ন ছাড়া কোনোভাবেই এ নগরকে আদর্শ নগরে পরিণত করা যাবে না।
নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, ২১ জুন ইভিএমে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে। ২৩ মে পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল করা যাবে। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ২৫ মে আর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১ জুন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলবে।