অতিরিক্ত শব্দ স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, মানসিক অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়

লাইফস্টাইল

ঢাকা শহরে রাস্তায় নামলে মাঝে মাঝে মনে হয় গাড়ি চালকেরা যেন হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কোনো কিছু সামনে পড়ে গেলেই কানফাটা শব্দে বেজে উঠছে হর্ন। এক সেকেন্ডও যেন অপেক্ষা করতে রাজি নন চালকেরা।

শুধু গাড়ির হর্ন নয়, এই শহরে নির্মাণ কাজ, গ্রিল, টাইলস কাটা, মেশিনে ইট ভাঙা, মাইক বাজানো, জেনারেটরের শব্দে কান ঝালাপালা অবস্থা।

সেই ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে শব্দের তাণ্ডব। দিনকে দিন ঢাকার শব্দ যেন আরো জোরালো হয়ে উঠছে।

এসব কারণে শব্দ দূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসঙ্ঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

এতদিন পর্যন্ত ঢাকায় শব্দ দূষণ রোধে যেসব প্রচারণা চালানো হয়েছে তাতে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথাই বেশি বলা হয়েছে।

কিন্তু মানুষের কানের যতটুকু সহ্য ক্ষমতা তার চেয়ে অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বসবাস শরীরের অনেক গুরুতর অসুখের কারণ।

আগের চেয়ে কানে কিছুটা কম শুনছেন কি?

জাতীয় নাক কান গলা ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আবু হানিফ বলেন, শব্দ দূষণে শরীরে যে অঙ্গটি সবচেয়ে প্রথম আক্রান্ত হয় সেটি হলো কান ও শ্রবণশক্তি।

তিনি বলেন, কানের ভেতরে রিসেপ্টর প্রথমে শব্দ তরঙ্গকে ধারণ করে, তারপর ককলিয়ার নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায়। দীর্ঘ দিন অতিরিক্ত শব্দ এই রিসেপ্টরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্রমাগত যারা অনেক শব্দের মধ্যে থাকেন তারা ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হারাতে থাকেন। অনেকে টেরও পান না যে তারা ধীরে ধীরে কানে কম শুনছেন।

ইউএনইপির প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দুটি শহরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকায় বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে শব্দের মাত্রা ১১৯ আর রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবল। যা একজন মানুষের কানের সহ্য ক্ষমতার অনেক বেশি।

অধ্যাপক হানিফ বলেন, একজন মানুষ সাধারণত ৪০ ডেসিবল শব্দে কথা বলে। যাকে বলা হয় বাড়ির ভেতরের শব্দ। সেটিই কানের জন্য সুস্থ মাত্রার শব্দ। মানুষের কান ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ সহ্য করতে পারে।

কিন্তু এর বেশি হলেই ক্ষতি। দিনের পর দিন যদি লম্বা সময় ধরে কেউ ৭০ ডেসিবলের ওপরে শব্দের মধ্যে থাকেন তাহলে শ্রবণশক্তি ক্রমশ কমে যেতে থাকে।

যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন তাদের মধ্যে সারাক্ষণ হর্ন বাজানো গাড়িচালক নিজেই রয়েছেন। আরো রয়েছেন ট্রাফিক পুলিশ, সড়কে দীর্ঘ সময় থাকতে হয় এমন কেউ, নির্মাণশ্রমিক।

কিন্তু আবাসিক এলাকাতেও যে পরিমাণে গাড়ির হর্ন, নির্মাণ কাজ বা মাইকের শব্দ শুনতে হয় তাতে নিজের বাড়িতে বসে থেকেও একজন মানুষের কান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

মাত্রাতিরিক্ত শব্দ হার্টের রোগের কারণ

অতিরিক্ত শব্দ যে হৃদযন্ত্রের অসুখের উৎস হতে পারে এমনটা অনেকেই চিন্তা করেন না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিও থোরাসিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিমেল সাহা বলেন, উচ্চমাত্রার শব্দের মধ্যে থাকলে মানুষের শরীরে অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। বেশি অ্যাড্রেনালিন মানুষের রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের হার বৃদ্ধি করে।

তিনি বলেন, চারপাশের পরিবেশে যদি উচ্চমাত্রার শব্দ থাকে এমন পরিবেশে অনেক সময় কাটলে অতিরিক্ত অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ক্ষরণ হতে থাকবে। তাতে হাইপারটেনশন হবে, প্রেশার বাড়বে। আর হাইপারটেনশন, প্রেশার বেশি থাকলেই হৃদরোগের ঝুঁকি অবশ্যই বাড়বে।

হাইপারটেনশন ও হৃদরোগ কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি করে।

শব্দ যেভাবে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়

কান শব্দকে গ্রহণ করে কিন্তু তার তরঙ্গ শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কে পৌঁছায় স্নায়ুর মাধ্যমে। মস্তিষ্কে কানের জন্য নির্ধারিত অংশ আছে। সেই অংশটির মাধ্যমেই আসলে মানুষের শ্রবণ প্রক্রিয়া কাজ করে এবং মানুষ শুনতে পায়।

অতিরিক্ত শব্দ তাই অবশ্যই মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলবে। শব্দ উচ্চ রক্তচাপ তৈরি করে আর মস্তিষ্কে স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণই হল উচ্চ রক্তচাপ।

অধ্যাপক হানিফ বলেন, যখনই উচ্চ মাত্রার শব্দ প্রতিনিয়ত কানের মাধ্যমে আপনার মস্তিষ্কে পৌঁছাবে, মস্তিষ্ক এক পর্যায়ে সেটা আর সহ্য করতে পারবে না। মস্তিষ্কের কোষে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া দেখা দেবে। উচ্চ রক্তচাপে মস্তিষ্কের রক্তনালী বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাতে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়, রক্তনালী ছিঁড়ে যায়। এগুলোই স্ট্রোকের মূল কারণ। অতিরিক্ত শব্দ দিয়েই এর শুরু হতে পারে।

উদ্বেগ, নিদ্রাহীনতা, খিটখিটে মেজাজ

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার বলেন, অতিরিক্ত শব্দ শুধু বিরক্তিরই উদ্রেক করে না এটি গুরুতর মানসিক রোগেরও উৎস।

তিনি বলেন, মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনে অনেক চাপের মধ্যে দিয়ে যায়। সেটি মোকাবেলার একটা ক্ষমতাও তার থাকে। কিন্তু সেজন্য সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। কিন্তু চারপাশের পরিবেশে যদি অসহনীয় কিছু থাকে যেমন অনেক উচ্চ শব্দ যখন মনে প্রতিনিয়ত বিরক্তির উদ্রেক করে, রাগ, চাপা উত্তেজনা তৈরি করে।

মেখলা সরকার বলেন, তখন মানুষের মনের চাপ মোকাবেলায় বাধা তৈরি হয়। উচ্চ শব্দ মনে খারাপ অনুভূতি তৈরি করে। চাপ সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে মানসিক সুস্থতা বাধাগ্রস্ত হয়।

শব্দ তাই মনে চাপ ও উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। উদ্বেগ নিদ্রাহীনতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

অন্যদিকে আবাসিক এলাকায় শব্দের কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।

এসব কারণে একজন ব্যক্তির মেজাজ খিটখিটে হতে পারে। মনোযোগ দিয়ে কাজ করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। শিশুদের শেখার ক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে।

আর শেষমেশ মানসিক চাপ ও নিদ্রাহীনতা শরীরের নানা অঙ্গকে প্রভাবিত করে।

এছাড়া একজন মানুষ যদি তার চারপাশের শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে রাগজনিত সমস্যা হতে পারে।

মানুষের মস্তিষ্ক সারাক্ষণ সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সঙ্কেত দেয়। অনেক জোরে শব্দ হলে তাই মানুষ ভয় পায়, কেঁপে ওঠে। সর্বক্ষণ চারপাশে উচ্চ শব্দে উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ার এটিও একটি কারণ।

অতএব ইচ্ছেমত মাইক বাজানো, গাড়ি অথবা মোটরসাইকেল চালানোর সময় সারাক্ষণ হর্নে চাপ দেবার আগে একটু ভাবা প্রয়োজন।

সূত্র : বিবিসি

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *