স্বীকৃতি বিশ্বাসঃ
সরস্বতী পূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী। সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। যা স্কুল, কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়।এবছর পঞ্চমী তিথি গতকাল বুধবার (২৫ জানুয়ারি) বিকাল একটা থেকে আজ বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) সকাল ১১ টা পর্যন্ত। তাই আজ ও আগামীকাল সকাল পর্যন্ত বাগদেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত।
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানতঃ নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী=সরস (জল)+মতুন (অন্ত্যর্থে)+ঙীন (স্ত্রী)। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হল জলবতী অর্থাৎ নদী। পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন, সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী, পরে হলেন দেবী। গঙ্গা যেমন হিন্দুর উপাস্য দেবী হিসেবে পূজা পেয়ে থাকেন তেমনি ক্রমান্বয়ে সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী। পুরাণে ও পুরাণোত্তর আধুনিককালে দেবী সরস্বতী বাক্য বা শব্দের অধিষ্ঠাত্রী বাগদেবীরূপে প্রসিদ্ধা। বৈদিক দেবী সরস্বতীর অন্য পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি কেবল বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপেই সুপ্রতিষ্ঠাত হয়েছেন। বৈদিক সরস্বতী বাগাধিষ্ঠাত্রী বা বাগদেবীরূপেও বর্ণিতা হয়েছেন। অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণে সরস্বতী বাগদেবী। বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা। তিনি বাকপতিও। ইন্দ্রও বাকপতি। বৃহস্পতি-পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সব জ্ঞানের ভাণ্ডার তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু আর মহেশ্বরের। তাদেরই শক্তিতে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ, ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন। দিনে দিনে সরস্বতী তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞানের দেবীতে পরিণত হন।
সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীন কালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াতকলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।
বর্তমানে সরস্বতী প্রায় সব জায়গায়ই দ্বিভুজা। তার এক হাতে বীণা ও অন্য জয়মালা থাকে । বীণা সঙ্গীত ও অন্যান্য কলাবিদ্যার প্রতীক। অক্ষরমালা বা জপমালাও আধ্যাত্মবিদ্যার প্রতীক। শুকপাখিও বিদ্যা বা বাক্যের প্রতীক হিসেবেই সরস্বতীর হাতে শোভা বাড়ায়।
এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যথা: অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার পূর্বে কুল ভক্ষণ করেন না। পূজার দিন কিছু লেখাও নিষিদ্ধ। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে।
সরস্বতী পুজার মূখ্য উদ্দেশ্যঃ সরস্বতী পূজার অঞ্জলি দিতে গিয়ে একটি মন্ত্র ঠাকুর মশাইয়ের সাথে সাথে উচ্চারণ করা হয় তা হলোঃ
“ভদ্রকাল্যৈ নম নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ
বেদ বেদাঙ্গ বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য এবচ।”
অর্থঃ হে ভদ্রকালী! তোমাকে প্রতিনিয়ত নমস্কার করি। হে সরস্বতী!তোমাকে বারবার নমস্কার করি। (মাগো) বেদ, বেদাঙ্গ ও বেদান্ত যেন আমার বিদ্যাস্থানে অধিষ্ঠিত থাকে।
মা সরস্বতী বেদ, বেদান্ত , বেদাঙ্গের জ্ঞান দান করেন।অর্থাৎ সরস্বতী পূজার মূখ্য উদ্দেশ্য জাগতিক অনিত্য বিদ্যা দান করা দেবীর প্রকৃত কাজ নয়। ভক্তরা সরস্বতী মায়ের কাছে কৃষ্ণভক্তিরূপ জ্ঞান প্রার্থনা করে, কৃষ্ণভক্তি প্রতিকূল মোহরূপ অজ্ঞানতা হতে মুক্ত হওয়ার প্রার্থনা করেন।
উল্লেখিত মন্ত্রে বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত – এর সাথে পুরাণ, মহাকাব্য, গীতা, দর্শন, শাস্ত্র ও সিদ্ধান্ত – এই সব কটি যোগ করে এক সাথে বলা হয় – বৈদিক সাহিত্য।হিন্দু ধর্মে ৪ টি বেদ হলোঃ ১.ঋক,২.সাম,২.যজু ও ৪.অর্থব।বেদাঙ্গ ৬ টি হলোঃ ১.শিক্ষা, ২.কল্প,৩.ব্যাকরণ,৪.নিরুক্ত, ৫.ছন্দ ও ৬. জ্যোতিষ, বেদান্ত ৪ টি হলোঃ ১.অর্থশাস্ত্র,২.যুদ্ধবিদ্যা,৩.নাচ-গান ও ৪. চিকিৎসা।
অর্থাৎ ১৪ টি বিষয়ে সম্যক জ্ঞানলাভের লক্ষ্য নিয়েই বিদ্যা ও জ্ঞানদেবী সরস্বতীর আরাধনাই পূজার মুখ্য উদ্দেশ্য।
উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন অতি প্রত্যুষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের গৃহ ও সার্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত।পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সার্বজনীন পূজামণ্ডপগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়।
পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কোনো কোনো হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পূজার পরদিন অরন্ধন পালনের প্রথা রয়েছে।
এছাড়া পূজার পরদিন পুনরায় পূজার পর চিড়ে ও দই মিশ্রিত করে দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়। এরপর পূজা সমাপ্ত হয়। সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।