সংসারের বড় ছেলে। লেখাপড়ায় মন বসে না। বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে আড্ডা দেওয়াটাই ছিল তার কাজ। নিজে খুব ডানপিটে স্বভাবের না হলেও বন্ধুদের ঝগড়া ফ্যাসাদের প্রভাব তার উপরও পড়ত। যার ফলস্বরূপ প্রায়ই বাসায় অভিযোগ যেত। বন্ধুদের উঠকো ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে সময় কাটানোর জন্য তাকে মামা নিয়ে যান একটি কালার ল্যাবে। সুন্দর পরিপাটি রুম, একদিকে মেশিন থেকে ছবি বের হচ্ছে প্রথম দিনেই ল্যাবের পরিবেশ মন কাড়ে। পরে ২/১ দিন ল্যাবে আসা যাওয়া করার পর দেখলেন ভালই লাগে। কালার ল্যাবের ডার্ক রুম থেকে শুরু হল কর্ম জীবন। সেই ডার্ক রুম থেকে শুরু করে বর্তমানে দাপটের সাথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রেস ফটোগ্রাফিতে।
এটা কোনও বইয়ের গল্প বা সিনেমার কাহিনী নয়। একজন ফটোপ্রেমিকের গল্প। গল্পের হিরো দেশের এক নাম্বার প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলোর ফটো জার্নালিস্ট আনিস মাহমুদ। কঠোর পরিশ্রম ও কাজের প্রতি নিঃসীম ভালবাসায় সিলেট শহরের এক মহল্লা থেকে তার নাম এবং কাজ এখন দেশব্যাপী বিস্তৃত ।
আজ ১৯ আগস্ট ‘বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৮৩৯ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিনটিকে ‘বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
ফটোগ্রাফি, আলোকচিত্র বা ছবি, যে নামেই হোক একটি ফটোগ্রাফ একটি গল্প তৈরি করে। ছবি তোলার আগে ও পরের সেই সময়, মুহূর্তগুলো হয়ে উঠে গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটি সময়কে ধারণ করে ছবি। যার ফলে একটি ছবি একটি ইতিহাসে রূপান্তরিত হয়। এ ক্ষেত্রে কেউ ইতিহাসের অংশ হয় আর কেউ ইতিহাস সৃষ্টি করে।
একটি ফটো তোলা যত সহজ একটি ভাল ফটো তোলা ঠিক ততটুকু কঠিন। তার উপর যদি হয় প্রেস ফটোগ্রাফি তাহলেতে নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। কারণ প্রেস ফটোগ্রাফিতে পরিবেশ পরিস্থিতি কখনোই নিয়ন্ত্রণে থাকে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক আন্দোলন, দাঙ্গা, হামলা সকল প্রতিকূল পরিস্থিতি উপেক্ষা করে রীতিমত যুদ্ধ করে ফটো তুলতে হয়।
এবার তবে বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবসে একজন ফটোপ্রেমিক ফটোযোদ্ধার গল্প শোনাব।
সিলেট শহরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা আনিস মাহমুদ। সদ্য কৈশোর পার করা যুবক। ২০০০ সালের দিকে মামার সাহায্যে কর্মজীবন শুরু করেন জিন্দাবাজার বর্তমান সিটি সেন্টার (সাবেক নওয়াব কমপ্লেক্স) এ কণিকা কালার ল্যাবের ডার্ক রুমে। কালার ল্যাবের কাজ শুরুতেই মন কাড়ে তার। তাই প্রথম ১ মাস কাজ করলেন। ১ মাস পর দোকান মালিক ৮০০ টাকা বেতন দিয়ে বলেন এ কাজ ভাল লাগলে কাজ শিখতে এসো। তিনিও চিন্তা করলেন যেমনই হোক একটা কাজ পেলেন। তাছাড়া তিনি যেহেতু সংসারের বড় ছেলে তাই পরিবারে আর্থিক সাপোর্ট করাও একটা দায়ভার আছে তার উপর। ৮০০ টাকা বেতনে প্রায় ২ বছর কাজ করছেন।
আনিস মাহমুদ বলেন, প্রথম দিকে ওস্তাদরা দেখাতেন কিভাবে ছবি ডেভোলাপ করতে হয়। আমিও মনের আনন্দে সব কাজ করতাম। আস্তে আস্তে ফটোগ্রাফির বেসিক জিনিসগুলো শেখার প্রতি আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। যেমন কালার, কালার ডেভোলাপ, সাদাকালো ডেভোলাপ, ম্যানুয়াল প্রিন্ট, এই জিনিসগুলো ওস্তাদ আলী ভাই যখন করতেন আমি রপ্ত করতাম। ল্যাবের কাজের প্রতি আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। তাই মোটামুটি দেখে দেখেই অনেক কাজই শিখে ফেলি। দেখা যায় দোকানে কেউ না আসলে তার কাজটা করে ফেলি। যেমন নেগেটিভ কাটা, ছবি কাটা ম্যানুয়ালি ছবি ডেভোলাপ- এসব।
ছবি তোলার প্রতি মানুষের আবেগ, আগ্রহ, দেখে তিনি ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন ছবি তোলা একটা শৈল্পিক কাজ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন ভবিষ্যতে যাই করেন না কেন হাতের কাজ হিসেবে এ কাজটা শিখে রাখা যায়। এরপর থেকেই ক্যামেরার প্রতি তার আগ্রহ বাড়তে থাকে।
তিনি বলেন, প্রথম থেকেই ক্যামেরার প্রতি আগ্রহ ছিল। যেহেতু ফটো কালার ল্যাব তাই কাজে ঢোকার ২ মাসের মধ্যেই ক্যামেরা হাতে নিয়েছি। কিন্তু ফটো তোলার জন্য না। এস এলআর ক্যামেরার ৩৬ রিল অনেকেই শেষ না করে নিয়ে আসতেন। তখন ডার্ক বক্সে ক্যামেরা ডুকিয়ে রিল খুলতাম। সেই সুবাদে ক্যামেরা ধরা হত। আমার মাথায় ছিল যে আমার সব শিখতে হবে। তাই যখনই দোকানে কেউ ছবি তুলতে আসেন আমি তখন ওস্তাদ আলী ভাই ও মতিন ভাইয়ের সাথে সাথে থাকতাম। দেখতাম উনি ক্যামেরা কিভাবে ধরেন। ছবি তোলার জন্য লাইট কিভাবে করেন। মাঝে মাঝে দেখতাম একটা ছবি তোলার পর কি জানি চেঞ্জ করতেন। পাসপোর্ট সাইজ ছবি তোলার সময় এক ধরনের লাইট, কালার ছবি তোলার সময় এক ধরনের লাইট করা হত। এগুলো দেখতাম।
কাস্টমার ছবির নেগেটিভ দিয়ে গেলে প্রায়ই ক্যামেরায় কিছু নেগেটিভ অবশিষ্ট থাকত। সেই অবশিষ্ট নেগেটিভ আনিস মাহমুদ কাজে লাগাতেন। সবাই দোকান থেকে চলে গেলে ওই নেগেটিভগুলা ক্যামেরায় ডুকিয়ে ইচ্ছামত ছবি তুলতেন। ডেভোলাপ করতেন। তবে ডিজিটাল মেশিনে সাহস পেতেন না। তাই ম্যানুয়ালভাবে ছবি প্রিন্ট করতেন।
তিনি বলেন, শুক্রবারে ল্যাব বন্ধ তাই প্রায়ই বৃহস্পতিবারে কোন না কোনও ভাবে দোকান থেকে ক্যামেরা নিয়ে যেতাম। শুক্রবারে বাহিরে বেরিয়ে যা ভাল লাগত তাই তুলতাম। বন্ধুদের ছবি তুলতাম। পরের দিন সকালে সবার আগে ল্যাবে আসতাম। যেন আমার ছবিগুলো আগে ডেভোলাপ করতে পারি। প্রিন্ট করে দেখতাম ছবি কেমন হয়েছে। আমার তোলা ছবিগুলো ওস্তাদকে দেখাতাম। আলী ভাই বলতেন ভাল হইছে। আবার জিজ্ঞেস করতেন ছবি তোলার সময় সাটার স্পিড কত ছিল। এভাবে এত পয়েন্টে তুললে আরও ভাল হত। তখন আমি পরের দিন ওস্তাদের কথা অনুযায়ী আবারও ছবি তোলে প্রিন্ট করে দেখাতাম। এভাবে আমি ছবি তোলাতে ও মোটামুটি পারদর্শী হয়ে গেলাম।
২০০৩ সাল থেকে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি করেন আনিস মাহমুদ। বিয়ে, সেমিনার সহ বিভিন্ন প্রোগ্রামে আউটডোরে পুরোদমে কাজ করেন। তার ১ম প্রফেশনাল ক্যামেরা ইয়াসিকা এফএক্স থ্রি। এখনো তার প্রিয় ক্যামেরা এটা।
আনিস মাহমুদ বলেন, প্রথম দিকে যখন প্রফেশনালি কাজ কাজ শুরু করি তখন আমি দেখতে ছোট ছিলাম তাই কাস্টমার দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে থাকত। যে আমি ছবি তুলতে পারব কিনা। পরে আমার তোলা ছবি দেখে তারা খুশি হতেন। আমাকে বাহবা দিতেন। তখন আমার কিছু কাস্টমার তৈরি হল। তারা আমাকে ছাড়া আর কারো হাতে ছবি তুলতেন না।
২০০৫ সাল পর্যন্ত সিলেটে কণিকা ল্যাবে কাজ করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমার কাজ শেখার পিছনে সব সময়ই দোকানের মালিক এবং ওস্তাদরা সাপোর্ট দিয়েছেন। এরপর ২০০৫ সিলেটের ল্যাব বন্ধ হয়ে যায়। এর ভিতর ছবি তোলা আমার নেশা হয়ে গেছে। ফটোগ্রাফি ছাড়া অন্য প্রফেশন মাথায় আসে না। তখন চিন্তা করছি ফটো ল্যাব ত দিতে পারব না। কোথাও চাকরি না পেলে নিজের স্টুডিও খুলব। মডেল ফটোগ্রাফি করব, বিয়ের ফটোগ্রাফি করবো। ও বছরই এ মালিকপক্ষ সুনামগঞ্জে ফটোজোন নামে আরেকটি ল্যাব খোলে। তখন আমি সুনামগঞ্জ কাজ শুরু করি। সুনামগঞ্জে আমি মন খুলে কাজ করি। কারণ সিলেট কাজ করেছি ওস্তাদের অধীনে আর সুনামগঞ্জে আমি নিজের মত করে কাজ করি। ওই রিল ক্যামেরার ছবিতে বৈচিত্র্য এনেছি বিভিন্ন টেকনিক করে।
২০০৯ সাল পর্যন্ত সুনামগঞ্জে কাজ করেন। দীর্ঘদিন ল্যাবে ফটোগ্রাফি করার পর জীবনের কোন অগ্রগতি পাচ্ছিলেন না। তাছাড়া পরিবার পরিজন সবাই সিলেটে। তাদের থেকে দূরে থেকে অন্যত্র কাজ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তার বন্ধু মাহমুদুর রহমান তারেক (বর্তমানে যমুনা টিভির সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি) তাকে প্রেস ফটোগ্রাফিতে আসার জন্য বলে। তখন তিনি চিন্তা করলেন সারা জীবন কি করলাম শুধু বর-বধূ, স্টুডিওর ছবি তুলবেন। তিনি বুঝতে পারলেন পত্রিকায় জন্য যেটা সেটাও ফটোগ্রাফি।
আনিস মাহমুদ বলেন, তারেক অনেক উৎসাহিত করে প্রেস ফটোগ্রাফিতে আসার জন্য। সে প্রায়ই বলত ফটোগ্রাফি সম্বন্ধে খুব ভাল জানি আমি। ল্যাবের চাকরি করে জীবন নষ্ট করছি। সে বলত আমি প্রেস ফটোগ্রাফিতে ভাল করব।
তখন আমি উজ্জল ভাইয়ের (উজ্জল মেহেদি) সাথে যোগাযোগ করি। উজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয় সুনামগঞ্জে। আমি যখন সুনামগঞ্জ কাজ করি তখন প্রথম আলোর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি ছিলেন উজ্জল মেহেদি ভাই (বর্তমানে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক)। যে মার্কেটে ল্যাব ওই মার্কেটে তার অফিস ছিল। উনি মাঝে মাঝে ল্যাবে ছবি প্রিন্ট করাতেন। উজ্জ্বল ভাইয়ের জন্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন নাটক, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি ও তুলে দিয়েছি। ঐ ছবিগুলো পত্রিকায়ও ছাপানো হয়েছে। কিন্তু ওই সময় কখনো চিন্তা করিনি প্রেস ফটোগ্রাফিতে আসবো। একপর্যায়ে উজ্জল ভাই সিলেট চলে আসলেন। আমি সুনামগঞ্জ রয়ে গেলাম। পরে যখন আমি প্রেস ফটোগ্রাফি করার সিদ্ধান্ত নেই তখন উজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু তখন সাইদুল ইসলাম অপু ভাই ফটো জার্নালিস্ট হিসেবে প্রথম আলোতে কর্মরত ছিলেন। উজ্জল ভাই, সুমন দা, সাইদুল ইসলাম অপু ভাই অনেক সহযোগিতা করেন। তখন প্রতিদিনই আমি প্রথম আলোর অফিসে আসি। ওই সময় অপু ভাইয়ের পরীক্ষা বা কোন সমস্যা থাকলে আমি ছবি তুলতাম। কিছুদিন পর অপু ভাইয়ে লন্ডনের ভিসা হয়ে যায়। অপু ভাই ঢাকা যান বলার জন্য তিনি আর কাজ করতে পারবেন না।
২০০৯ সালের শেষের দিকে আন-অফিসিয়ালি প্রথম আলোর প্রথম এসাইনমেন্ট নৌকা বাইচ। আমি ক্যামেরা নিয়ে যখন কিন ব্রিজের নিছে ছবি তুলি। ছবিটা পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় ছাপানো হয় অপু ভাইয়ের নামে। এরপর অপু ভাই সাথে নিয়ে ঢাকা যান। প্রেস ফটোগ্রাফি আসার শুরুর দিকে অনেকে মশকরা করেছে। কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল আমি পারব। যখন শুরু করব তখন আমার কাছে কিছুই নাই। অপু ভাই যাওয়ার সময় তার ব্যবহারের ক্যামেরা, মোবাইল এমনকি তার একমাসের বেতনও আমাকে দিয়ে গেছেন।
প্রথম আলোতে কাজে করার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে নভেম্বরের দিকে অফিস জানে যে আনিস নামে একটি ছেলে কাজ করে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে দৈনিক প্রথম আলোতে নিয়োগপত্র পাই।
তার প্রথম অফিসিয়াল এসাইনমেন্ট ছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) হাসন-লালন উৎসব। ওই উৎসবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে দেখেন ছাত্রলীগের নেতারা চেয়ার দিয়ে মারামারি করছেন। তিনি ছবি তোলা শুরু করেন। তার ছবি তোলা দেখে ছাত্রলীগ নেতারা এসে মারধরও করে।
আনিস মাহমুদ বলেন, প্রথম দিনেই প্রোগ্রাম কাভার করতে গিয়ে মার খেয়েছি। সেইজন্য মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল। পরের দিন এই ছবিটা ছাপা হয়। পত্রিকায় ছবি দেখে মন ভালো হয়ে গেল। কিছুদিন পর আমি নিজে একটা ক্যামেরা কিনলাম। নিজের কিনা প্রথম ক্যামেরা নাইকন ডি ফোরটি। ছাত্রদলের ২ গ্রুপের মারামারি কাভার করতে গিয়ে এ ক্যামেরাটাও ছাত্রদলের কর্মীরা ভেঙে দেয়। তখন মনটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল। চিন্তা করলাম প্রেস ফটোগ্রাফিতে এসেই এখন পদে পদে বাধা পাচ্ছি। একটু হতাশও হয়েছিলাম।
তখন উজ্জল ভাই বলেন ফটো সাংবাদিক মানে মিটিং মিছিল এর ছবি তোলা না। প্রকৃতি, গাছপালা, পশু পাখি সব কিছুর ভাল ছবি তোলা ও ফটো সাংবাদিকের কাজ। নিজের জন্য ছবি তোল। তোমর যা ভাল লাগে তাই তুলে আনবে।
আনিস মাহমুদ বলেন, ঐ সময় প্রায়ই আমার পকেটে টাকা থাকত না। তখন বাসা থেকে পায়ে হেঁটে বের হতাম। হাটতে হাটতে রাস্তাও শেষ হত আর ছবি তুলতাম। প্রায় ১ বছর এভাবে কাজ করি। এত হাঁটতাম পায়ে ব্যথা করত। পরের দিন আবার বের হতেও খুব কষ্ট হত। কিন্তু আমি বের হয়েছি। কারণ আমার নিজের সাথে চ্যালেঞ্জ ছিল আমি পারব। ঐ সময় বন্ধু এফএম মুন্না অনেক সাহায্য করে। তার মোটরসাইকেল দিয়ে অনেক জায়গায় নিয়ে যেত ছবি তোলার জন্য। তাছাড়া অনেকে আমাকে তাচ্ছিল্য করত। তাদের জবাব দিতেই কখনো কষ্টকে কষ্ট মনে করি নাই। আমি মনে করতাম যারা এখন আমাকে তাচ্ছিল্য করছে একদিন তারাই আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করবে। আমার নাম পরিচিতি হওয়ার পর অনেকেই এসেছে আমার কাছে।
পত্রিকায় ছবি ছাপানো প্রসঙ্গে আনিস মাহমুদ বলেন, প্রথমদিকে বেশি ছবি পত্রিকায় আসত না। মাসে এক দুইটা ছবি ছাপা হত আমার। কারণ সারা বাংলাদেশে তখন প্রথম আলোতে খুব নামীদামী ফটোসাংবাদিকরা কাজ করেন। তখন উজ্জ্বল ভাই বললেন ঋতু মনে রাখতে। ঋতুভিত্তিক ছবি তুলতে। তার কথা মত আমি কাজ শুরু করালাম। ফিচার ছবি কিভাবে কোন সময় তোলা লাগে উজ্জ্বল ভাই বলে দিতেন। ২০১২ এর অনেক ছবি আলোচিত হয়। যেমন রাতারগুল, ইলিয়াস আলী ইস্যু, এমসি কলেজের অস্ত্রবাজির ছবি, সরকারি কলেজের ছাত্রশিবির-ছাত্রলীগের ছবি, দক্ষিণ সুরমার বাস পোড়ানোর ছবি এ সমস্ত ছবিগুলো তখন খুব আলোচিত হয়। মানুষ জানতে শুরু করে আনিস মাহমুদ নামে একজন ফটোগ্রাফার আছে। এরপর থেকে যারা আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন তারা পছন্দ করা শুরু করলেন। প্রথম আলো থেকে প্রায় ৬০টা অভিনন্দনপত্র পেয়েছি এখন পর্যন্ত।
আনিস মাহমুদ ২০১২ সালেও প্রথম আলোর সেরা আলোকচিত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন এবং পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৪ সালে প্রথম আলোর সেরা কর্মীর পুরষ্কার হিসেবে ফটোসাংবাদিক বিভাগে তিনি পুরস্কার পান। তার তোলা একাধিক ছবি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সিলেটকে নতুন করে পরিচিত করে তুলেছে।
ল্যাবের ডার্ক রুমের কাজের বিষয়ে আনিস মাহমুদ বলেন, ডার্ক রুমের কাজটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। অন্ধকারে মনের চোখ দিয়ে দেখে কাজ করতে হত। তাই ডার্ক রুমের কাজে মজা পাওয়া যেত। তবে ছবি ডেভোলাপ করতে কেমিক্যাল লাগে। ডেভোলাপ করতে করতে হাতে পচন ধরে যায়। তখন মনে হত ডার্ক রুমের কাজের প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হত।
আগের ও বর্তমান সময়ের ফটোগ্রাফি নিয়ে আনিস মাহমুদ বলেন, এখন ঘরে বসে ফটোগ্রাফি শেখা যায়। কিন্তু আগে এমন ছিল না। আগে ফটোগ্রাফি ছিল সাধনা। আগে এক লেন্সে এক ক্লিকে ছবি তোলা হত। সভা সেমিনার মিটিং মিছিল বিয়ে গায়ে হলুদ সব এক লেন্সে হত। এখনতো অনেক লেন্স ব্যবহার করেও একটা ভালো ছবি তুলতে গেলে অনেক ক্লিক লাগে। মূলত ক্যামেরার সাথে মনের যোগাযোগ প্রয়োজন। তখন এএলআর যুগ ছিল। আর এখন ডিএসএলআর। কিন্তু ক্যামেরার ফাংশন তখন যা ছিল এখন ও তাই আছে। এপাচার, আইএসও, সাটার স্পিড তখনও ছিল।
তিনি বলেন, ছবি ভাল করার ক্ষেত্রে ফটোশপ সহ বিভিন্ন সফটওয়্যার বা প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের কাজকে অনেক কিছু সহজ করে দিলেও ছবি তোলার মূলধারা থেকে সরে যাচ্ছি আমরা। বর্তমান প্রজন্ম এডিটের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমি চাই এডিটের উপর নির্ভরশীল না হয়ে সবাই যেন ম্যানুয়ালি কিভাবে ভাল ছবি তোলা যায় সেদিকে নজর দেন।
ছবি তুলেছেন: মামুন হোসেন ও অসমিত অভি।
শেয়ার করুন