সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপিদলীয় বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর পথ অনুসরণ করেছেন বিএনপির ১৪ নেতা। আরিফের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পর একে একে বিএনপি নেতারা নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত বিএনপির ১৪ নেতা কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ঘোষণা দেন। আগামী ১ জুন প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময়ের আগে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। আরও কয়েকজন বিএনপি নেতা তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিতে পারেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হলেও বর্তমান সরকারের অধীনে যেকোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এরপরও কাউন্সিলর পদে দলের অনেক নেতা-কর্মী মাঠে সক্রিয়। এর মধ্যে গত শনিবার বিকেলে সিলেটের রেজিস্টারি মাঠে এক নাগরিক সভায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ঘোষণা দেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
এরপর থেকেই দলটির কাউন্সিলর প্রার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিতে থাকেন। এতে সিলেটে মেয়র পদের পাশাপাশি অধিকাংশ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদেও একতরফা নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান মেয়রের নির্বাচনে না আসার ঘোষণায় নির্বাচন কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হচ্ছে না। এর মধ্যে বিএনপি নেতারা কাউন্সিলর পদেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে সিলেটের নির্বাচনী পরিবেশ ধূসর ও বিবর্ণ হয়ে গেল।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা জানান, সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে দলের সম্ভাব্য ৩২ নেতা-কর্মীকে চিঠি দেয় মহানগর বিএনপি। প্রার্থী হলে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের কথাও মৌখিকভাবে জানানো হয় তাদের। এর মধ্যে গত শনিবার মেয়র আরিফুলও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীদের ওপর আলাদা চাপ তৈরি হয়। আরিফুল হক নিজেও সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করছেন।
এ ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদীর, জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ও মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইনের সম্মিলিত তৎপরতায় কাউন্সিলর প্রার্থীরা মতবিনিময় সভা বা সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।
গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রথম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের টানা চারবারের কাউন্সিলর বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। এরপর রোববার সংবাদ সম্মেলন করে চারজন, সোমবার চারজন ও সর্বশেষ গতকাল পাঁচজন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ঘোষণা দেন। এ সময় অধিকাংশ সভা ও সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আরিফুল হক, মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেনকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।
আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘দেশে নির্বাচনের পরিবেশ না থাকায় নির্বাচন বর্জন করেছি। বিএনপির যেসব নেতা কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হতে চাচ্ছেন, তাদেরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার অনুরোধ করেছি। অনেকে ইতিমধ্যে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। আরও অনেকে সরে দাঁড়াবেন।’
কয়েস লোদী ছাড়া নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া ব্যক্তিরা হলেন ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. আমির হোসেন, ২২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর সৈয়দ মিসবাহ উদ্দিন, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে জেলা বিএনপির শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান, ২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মামুন ইবনে রাজ্জাক, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক দিনার খান, ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে মদনমোহন কলেজ ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক মকসুদুল করিম, ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মো. বজলুর রহমান, সংরক্ষিত ২ নম্বর ওয়ার্ডে মহিলা দলের নেত্রী রেহানা ফারুক, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের আহ্বায়ক শাহ মো. ফজলুল কাদির সিদ্দিকী, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা সাইদুর এনাম চৌধুরী, যুবদল নেতা কাঁচা মিয়া, আবদুল মালেক ও ১১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য শেখ লিমনুজ্জামান।
মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, যে ৩২ নেতাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে মহানগর বিএনপি চিঠি দিয়েছে, তাদের মধ্যে ১৪ জন ইতিমধ্যে দলের নির্দেশনা মেনে সরে দাঁড়িয়েছেন। বাকিরা প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখের আগেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেবেন বলে দল আশা করে।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ব্যাখ্যায় ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সৈয়দ আমির হোসেন বলেন, ‘কাউন্সিলর পদে প্রতীক ছাড়া নির্বাচন হওয়ায় আমি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলাম। যেহেতু দল চায় না বর্তমান সরকারের অধীনে কাউন্সিলর পদেও কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক, তাই সরে দাঁড়িয়েছি। সংগ্রহ করা মনোনয়নপত্রটিও জমা দেব না।’
বিএনপির অন্তত ২০ থেকে ২৫ নেতা-কর্মী ও সমর্থক কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বলে দলের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে বর্তমান কাউন্সিলর থেকে শুরু করে দলের প্রভাবশালী নেতারাও আছেন। পাঁচজন বর্তমান কাউন্সিলর মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
তারা হলেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির নেতা ফরহাদ চৌধুরী, ১ নম্বর ওয়ার্ডে সৈয়দ তৌফিকুল হাদী, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য এ বি এম জিল্লুর রহমান। এ ছাড়া বর্তমান সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ও মহানগর মহিলা দলের আহ্বায়ক রোকসানা বেগমও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া জেলা মহিলা দলের সভাপতি সালেহা কবির, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আলতাফ হোসেন প্রার্থী হয়েছেন।
জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবেই স্থানীয় নির্বাচন তারা বর্জন করছেন। এরই অংশ হিসেবে সিটি নির্বাচনেও বিএনপি যাচ্ছে না। শুধু মেয়র পদে নয়, কাউন্সিলর পদেও কেউ যেন প্রার্থী না হন, দলের নির্দেশনা আছে। সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ প্রার্থী হলে স্থায়ী বহিষ্কার হতে হবে বলে দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে জানানো হয়েছে।