আশ্বিনে বৃষ্টিমুখর দেশ, জনজীবন-কৃষিতে প্রভাব

জাতীয়

আশ্বিনের শেষ, অপেক্ষায় শীতের আগমন। ভরা বর্ষা মৌসুম বৃষ্টিহীনতায় কাটলেও আশ্বিনের এমন সময়ে এসে দেখা মিলেছে টানা বৃষ্টির। কখনও ঝিরিঝিরি কখনও মুষলধারে শুরু হওয়া বৃষ্টি রাজশাহী ডুবিয়ে এলো ময়মনসিংহ অঞ্চলে। আবহাওয়া অফিস বলছে, এখন এটি সিলেটের দিকে এগিয়েছে।
অক্টোবরের এই সময়ে মৌসুমি বায়ু যাব যাব করার সময়। কিন্তু এই বায়ু বিদায় নেওয়ার আগে যেন ‘আষাঢ়ের’ বারিধারা বইয়ে দিলো। কিন্তু এ তো হালকা বৃষ্টি নয়। সিলেটসহ দেশের প্রায় সব এলাকায় তিন দিন ধরে প্রবল বৃষ্টি হতে দেখা গেছে। বছরের এ সময়ে এমন বৃষ্টি কি খুবই অস্বাভাবিক? বাংলাদেশের আবহাওয়ার তথ্য বলছে, এ সময়ে এমন বৃষ্টি আগেও হয়েছে। কখনো কখনো এর চেয়ে বেশি বৃষ্টিও হয়েছে। প্রশ্ন হলো, শিউলি-ঝরা আশ্বিনে এত বৃষ্টি কেন হয়?

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ বজলুর রশিদ বলেন, খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এই সময়টাই বেশি বৃষ্টি হয় দেশের উত্তরাঞ্চলে কিংবা ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এদিকটায় পশ্চিমা লঘু চাপের বর্ধিত অংশ সক্রিয় থাকে। পুবালি বাতাসের সঙ্গে সংঘাতের ক্ষেত্র এই স্থানগুলোই। তাই বৃষ্টি বেশি হয় এসব অঞ্চলে।
বৃহস্পতিবার দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় ময়মনসিংহে ৩৭৮ মিলিমিটার। দেশের ইতিহাসে অক্টোবরে মাসে রেকর্ড হওয়া বৃষ্টির দিক থেকে এই বৃষ্টি তৃতীয় সর্বোচ্চ। ১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর ময়মনসিংহে বৃষ্টি হয়েছিল ৩৮১ মিলিমিটার। দেখা গেছে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বড়জোর ১০ তারিখের মধ্যেই প্রবল বৃষ্টি হয়।

সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে ৫০.৮ মিলিমিটার। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ২৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে সিলেটে। আর সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সিলেটে ২৫.৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ৩৪.৪ মিলিমিটার ও ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টায় সিলেটে ১৪৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, মৌসুমি বায়ু অক্টোবরের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই মোটামুটি বিদায় নেওয়ার অবস্থায় চলে যায়। বৃষ্টির দাপট তাই এই সময়ে বাড়ে।
আবার অক্টোবর ও নভেম্বর ‘ঘূর্ণিঝড়প্রবণ’ মাস হিসেবে পরিচিত। দেশে সাধারণত মৌসুমি বায়ু আসার আগে এবং চলে যাওয়ার পর ঘূর্ণিঝড় হয়। মৌসুমি বায়ু আসার আগে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে ঘূর্ণিঝড় হয়। আবার চলে যাওয়ার পর অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৮৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৬২০টি ঘূর্ণিঝড় ও অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। আর নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে ৯৪১টি। ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অক্টোবর মাসে হয়েছে ২৫৫টি, নভেম্বরে ২১৯ ও ডিসেম্বরে ১০৫টি। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অক্টোবরে ৪২টি, নভেম্বরে ৭৪ ও ডিসেম্বরে ২৮টি হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর চলতি অক্টোবর মাসের যে পূর্বাভাস দিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, দু-তিনটি লঘুচাপ ও একটি নিম্নচাপ হতে পারে। সেই নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। আবহাওয়াবিদদের মতে, এবারের বৃষ্টি সাগরে তৈরি হওয়া লঘুচাপ এবং মৌসুমি বায়ুর প্রভাবেই হয়েছে। আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৮৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অক্টোবর মাসে সাগরে এ পর্যন্ত নিম্নচাপ হয়েছে ১২৯টি, নভেম্বরে ৭১ ও ডিসেম্বরে ৪৫টি।
এ মাসে তবে কি টানা বৃষ্টির এখানেই পরিসমাপ্তি?-এমন প্রশ্নের জবাবে আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, এ মাসে আরেকটি নিম্নচাপের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেটা যদি না হয়, তবে এইবারের মতো টানা বৃষ্টি এ মাসে আর হবে না।

বৃষ্টিতে শীতকালীন কৃষির ওপর প্রভাব :

বাজারে এখন কিছু কিছু শীতকালীন শাকসবজি আসা শুরু হয়েছে। এগুলো বাস্তবে শীতের সাক্ষ্য সবজির বৈশিষ্ট্য বহন করে না। এগুলোকে কৃষিবিদেরা বলে থাকেন অফ সিজন ভ্যারাইটি। শীতকালীন শাকসবজির আবাদ শুরু হয় সাধারণত মধ্য অক্টোবরে।
কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় বলেন, যারা শীতকালীন শাকসবজির জন্য ক্ষেত প্রস্তুত করছেন, তাদের ক্ষতি হতে পারে এই বৃষ্টিতে। এ ছাড়া এখন ধান আছে ক্ষেতে, যেসব ধানে ফুল এসে গেছে, সেসব ধানের হয়তো খুব বেশি ক্ষতি হবে না।আমন মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় বিপাকে ছিলেন কৃষকেরা। অনেকে সেচ দিয়ে আমন ধান রোপণ করেছেন। এতে তাঁদের বাড়তি খরচ হয়েছে। অবশেষে আশ্বিনের বৃষ্টি কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় শুকিয়ে যাওয়া প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সেই সাথে কৃষকরাও সেচ ছাড়া বৃষ্টির পানিতে আমন ধানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

এদিকে, টানা বৃষ্টিতে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। কিভাবে জোগাড় হবে প্রতিদিনের ডাল-চালের খরচ, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার টাকা কিংবা এনজিওর কিস্তির টাকা। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির কারণে মাথায় ভারী হচ্ছে চিন্তার বোঝা।নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এক শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষ বৃষ্টির মধ্যেই চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের কর্ম। অপরদিকে কৃষকের কাজ থেমে থাকলেও থেমে নেই ভ্যানচালকের ভ্যান চালানো। ভ্যানের ওপরে পলিথিন টাঙিয়ে ছুটে চলছেন বিভিন্ন এলাকায়।সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব আহমদ জানান, বঙ্গোসাগরে লঘুচাপ অবস্থান করছে। এর প্রভাবে বিভাগে বৃষ্টি হচ্ছে। সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় শুক্রবার হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হয়েছে। আজ শনিবার থেকে বিভাগে কমতে পরে বৃষ্টিপাত।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *