ইলিশ রপ্তানিতে এত কূটনীতি কেন

জাতীয়

কেউ বলছেন ইলিশ একটি রাজনৈতিক মাছ। কেউ বলেছেন এটি একটি কূটনৈতিক মাছ। কারণ, গত কয়েক বছর ধরেই মাছটি নিয়ে চলছে হরেক রকম রাজনীতি ও কূটনীতি।

ইলিশ নিয়ে দেশের মানুষের ভাবনার যেন অন্ত নেই। সাধারণ মানুষ থেকে সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও ইলিশ ইস্যুতে বাজিমাৎ করে দিচ্ছেন। সবশেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ইলিশ ভাবনায় মশগুল। পক্ষ, বিপক্ষ, ব্যঙ্গ— সব আছে সেখানে। কেউ বলছেন ইলিশ একটি রাজনৈতিক মাছ। কেউ বলেছেন এটি একটি কূটনৈতিক মাছ। কারণ গত কয়েক বছর ধরেই মাছটি নিয়ে চলছে হরেক রকম রাজনীতি ও কূটনীতি।

বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির সূত্র মতে, দেশে বছরে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। চলতি বছর দেশে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ ত্রিশ হাজার মেট্রিক টন। তা থেকে রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে মাত্র তিন হাজার মেট্রিক টন। যা মোট উৎপাদনের মাত্র শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন, “যে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে তা চাঁদপুর ঘাটের একদিনের সমপরিমাণও নয়।” প্রশ্ন হচ্ছে তাতে কি দেশি ভোক্তাদের ইলিশ মাছ প্রাপ্তিতে বা বাজারমূল্যে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে গেল? আর এই রপ্তানি পণ্য বিনে পয়সায় দেওয়া হচ্ছে না। আগেও কখনও দেওয়া হয়নি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। যেটি প্রায় তিন কোটি ডলার। যা প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকার সমান বৈদেশিক মুদ্রা।

বাংলাদেশ প্রতিবছর ভারত থেকে আমদানি করছে রুই, কাতলা, পোয়া, ম্যাকারেলসহ লইট্টা, কাঁচকি ও পোয়া শুঁটকি। এসবের আমদানি খরচ ইলিশ রপ্তানির আয়ের সমান। কিন্তু প্রতিবছর যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়, ওই পরিমাণ সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। সরবরাহের জন্য বরাদ্ধকৃত সময় থাকে কম, মাত্র দু-সপ্তাহ। এই যেমন এবার ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইলিশ রপ্তানির আবেদন জানাতে হবে। ১৩ অক্টোবর থেকে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ। এ সময়ের মধ্যে যা পাঠানো যায়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭৬ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৯৯ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ১ হাজার ২৩০ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০২ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির হয়েছে। সর্বশেষ প্রতি কেজি ইলিশ মাছের রপ্তানি মূল্য ছিল কেজিপ্রতি ১০ ডলার বা প্রায় ১২০০ টাকা। তার মানে তিন হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি করতে না পারলে ভারত থেকে আমদানিকৃত তাজা মাছ ও শুঁটকি মাছের খরচ মেটানো সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে রিজার্ভ থেকে ওই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এটাই বাস্তবতা।

কিন্তু এ বাস্তবতায় আগে থেকে ঘি ঢেলে রেখেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা। মাত্র ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তার ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন। পোস্টটি ভাইরাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখন। তিনি লিখেছিলেন, “৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ! বিপুল পরিমাণে ইলিশ ভারতে রপ্তানি করে তাদের কেন খুশী করা হচ্ছে? সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষ মেরে ফেলার জন্য? অভিন্ন নদীর পানি থেকে আমাদের বঞ্চিত করার জন্য? বাণিজ্য ভারসাম্য না রাখার জন্য? কথায় কথায় বাংলাদেশ সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের জন্য?” তার মানে তিনি ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিপক্ষে। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টার মতে, এই সব বাতচিত ‘ইমোশনাল’।

অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ২২ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “রপ্তানির বিপক্ষে যারা বলে তারা ইমোশনাল। এর বাণিজ্যিক সুবিধা আছে। ফরেন কারেন্সি আসে।” অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী এমন ইমোশনাল কথা বলেছেন আরও একজন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “আমরা ক্ষমা চাচ্ছি। ভারতে কোনো ইলিশ পাঠাতে পারব না। এটা দামি মাছ। … আমরা দেখেছি যে আমাদের দেশের মানুষই ইলিশ খেতে পারে না। কারণ, সব ভারতে পাঠানো হয়।” এসব ‘ইমোশনাল’ কথাবার্তাকে পাত্তা না দিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টার ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত দু-দেশের সম্পর্ককে স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দুর্গাপূজার প্রাক্কালে এটি একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত।

অন্যদিকে, ইলিশ রপ্তানিতে যে অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা ঠেকাতে আইনি নোটিস দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আমদানি-রপ্তানির কার্যালয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রককে নোটিসের জবাব দিতে বলা হয়েছে। মাহমুদুলের নোটিসে বলা হয়, ইলিশ মাছ বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়। ভারতের বিশাল ও বিস্তৃত সমুদ্রসীমা রয়েছে, যেখানে ব্যাপকভাবে ইলিশ উৎপাদন হয়। এই বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের ইলিশ মাছ আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু ভারত মূলত বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ইলিশ আমদানি করে থাকে।

ইলিশ নিয়ে রাজনীতিতে ও কূটনীতিতে রয়েছে হরেক রকম মতভেদ। তেমনি ইলিশের রয়েছে নানান প্রকারভেদ। চন্দনা ইলিশ, খইরা ইলিশ, জাইতকা ইলিশ, ফাঁসা ইলিশ। নদীর ইলিশ, সমুদ্রের ইলিশ। নদীর মধ্যে আবার মেঘনার ইলিশ, রূপসার ইলিশ, ইলিশা নদীর ইলিশ, পদ্মার ইলিশ, গঙ্গার ইলিশ। এই পদ্মার ইলিশ নিয়েই যত রাজনীতি আর কূটনীতি। পদ্মার ইলিশে তেল বেশি, উজ্জ্বলতা বেশি, স্বাদও বেশি। মূলত পদ্মার ইলিশের চাহিদা বেশি ভারতে। রপ্তানি হয় এটিই।

ইলিশ ব্যবসায়ীরা সারা বছর ধরে পদ্মার ইলিশ প্রক্রিয়াজাত করে রাখে। রপ্তানির অনুমতি মিললেই সেটি ভারতে পাঠায়। এছাড়া সারাবছর এটি কালোবাজারিদের হাত দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত যায়। তার ফলে পদ্মার ইলিশ দেশের বাজারে সহজে পাওয়া যায় না। পেলেও দাম বেশি। এদিকে দেশে মোট ইলিশ উৎপাদনের কত ভাগ পদ্মার ইলিশ তার তেমন কোনো তথ্য নেই। তথ্য থাকলে সেখান থেকে কিছু ইলিশ রপ্তানি করা যায়। দেশে পদ্মার ইলিশের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ইলিশ কালোবাজারি বন্ধ করা। দেশে পদ্মার ইলিশের এমন আকাল যে, অদূর ভবিষ্যতে কেউ কলকাতা গেলে হয়তো ভারতীয় শাড়ি না কিনে পদ্মার ইলিশ কিনে দেশে ফেরার কথা ভাববে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *