শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সম্প্রীতির সুবাতাস। সামগ্রিকভাবে এই হচ্ছে সিলেটের রাজনীতির মঞ্চের দৃশ্যপট। তবে সেই দৃশ্যপট এখন বদলে যেতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সিলেটে রাজনীতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকবে কিনা, তা নিয়ে আছে শঙ্কা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির চিত্রপট বদলাতে শুরু করেছে। জাতীয় পর্যায়ে যে বৈরী মনোভাব বিরাজমান, তার রেশ লাগছে সিলেটের রাজনীতিতেও। ফলত প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখানে অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি নেতা আ ফ ম কামাল খুনের ঘটনাই সিলেটের রাজনৈতিক মোড় অনেকটাই ঘুরিয়ে দিয়েছে। এ ঘটনার পরম্পরা যেসব ঘটনা ঘটছে, তা এখানকার রাজনীতির ময়দানের শান্তিপূর্ণ অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।আ ফ ম কামাল সিলেট জেলা বিএনপির সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ কমিটির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাবেক প্রচার সম্পাদক। এ ছাড়া সিলেট ল কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
গত রোববার রাতে নগরীর আম্বরখানা বড়বাজার এলাকায় খুন হন আ ফ ম কামাল। পুলিশের ভাষ্য, তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগ কর্মী আজিজুর রহমান সম্রাটকে প্রধান আসামি করে ১০ জনের নামোল্লেখসহ হত্যা মামলা হয়েছে। পুলিশ ও র্যাব কুটি মিয়া, মিশু ও মনা নামের তিন আসামিকে গ্রেফতার করেছে।
কামাল খুনের পরপরই রাজপথে নেমে আসেন বিক্ষুব্ধ বিএনপি নেতা-কর্মীরা। বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবকদলসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা নগরীতে বিক্ষোভ করেন। তাদের বিক্ষোভ থেকে চৌহাট্টা ও রিকাবীবাজার এলাকায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়, ভাঙচুর করা হয়। এসব ব্যানার-ফেস্টুনে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হয়।
বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বিক্ষোভের খবর পেয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনও পাল্টা বিক্ষোভ বের করে নগরীতে। তখন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড ছিঁড়া ফেলা ও ভাঙচুর করা হয়। বিক্ষোভ থেকে বিএনপিবিরোধী স্লোগান দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি সম্বলিত আওয়ামী লীগের ব্যানার-ফেস্টুন ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ চার ছাত্রদল নেতাকে গত সোমবার গ্রেফতার করে। তারা হলেন- ইশতিয়াক আহমদ রাজু, বদরুল ইসলাম নজরুল, মিলাদ আহমদ ও রাজীব আহমদ। পরে গত মঙ্গলবার ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
এদিকে, ব্যানার-ফেস্টুন-বিলবোর্ড ভাঙচুরের ঘটনায় গত মঙ্গলবার রাতে সিলেট বিএনপির আড়াইশ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে আওয়ামী লীগ। মামলার বাদী মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য জাহিদ সারওয়ার। মামলায় কোনো নেতা-কর্মীর নামোল্লেখ করা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ, সবাইকে অজ্ঞাত হিসেবে আসামি করা হয়েছে।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন সিলেটভিউকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মামলা করেছে। যারা ভাঙচুর করেছে, তাদেরকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।’গত সোমবার ছাত্রদলের যে চার নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তদন্তসাপেক্ষে তাদেরকে আওয়ামী লীগের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সুদীপ দাস।
শুধু মামলাই নয়, বিএনপিকে ‘সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার’ আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। গত মঙ্গলবার রাতে তাদের পক্ষ থেকে এই বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।তবে মামলা দায়েরকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বলে দাবি করছে সিলেট বিএনপি। এ ধরনের প্রক্রিয়া সিলেটের রাজনৈতিক সহাবস্থানে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে বলেও মনে করছে দলটি।
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী সিলেটভিউকে বলেন, ‘এগুলো হচ্ছে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা। ১৯ নভেম্বর আমাদের যে গণসমাবেশ আছে, সেটিকে বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে মামলা দেওয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের প্রক্রিয়া সিলেটে রাজনৈতিক সম্প্রীতি, সহাবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।’তিনি বলেন, ‘যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে, ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে সিলেটবাসীকে সাথে নিয়ে গণসমাবেশ সফল করা হবে ইনশা আল্লাহ।’
কাইয়ুম চৌধুরী দাবি করেন, ‘যে ঘটনায় মামলা দিয়েছে আওয়ামী লীগ, এ ধরনের কোনো ঘটনার সাথে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কেউ জড়িত নয়।’অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপিতে ‘উচ্ছৃঙ্খল’ যারা আছেন, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ সিলেটভিউকে বলেন, ‘বিএনপি সরকার পতনের কথা বলছে, আলটিমেটাম দিচ্ছে। এই চিন্তা থেকে তারা বেপরোয়া হচ্ছে কিনা, সেটা ভাবার বিষয়।’তিনি বলেন, ‘বিএনপির মধ্যে অনেকেই আছেন শান্তিপ্রিয়। তাদের উচিত যারা উচ্ছৃঙ্খলতায় জড়িত, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা। অন্যথায় এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
শেয়ার করুন