সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের শ্লীলতাহানি ও দুই শিক্ষার্থীর ওপর হামলার অভিযোগের ঘটনায় গড়ে ওঠা আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে আন্দোলনকারীরা এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছেন। এর মধ্যে বাকি আসামিরা গ্রেফতার না হলে পুনরায় আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে নিজেদের আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা!
আন্দোলনকারীদের পক্ষে ওসমানী মেডিকেলের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মুন্তাকিম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই ঘটনায় প্রধান আসামি দিব্যকে আমাদের পুলিশ বাহিনী গ্রেফতার করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সম্মানিত ভিসি মহোদয়, সম্মানিত পরিচালক স্যারসহ আমাদের সম্মানিত শিক্ষকদের অনুরোধে আমরা কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করছি। আমরা সাতদিন সময় বেঁধে দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে যদি বাকি আসামিরা ধরা না পড়ে, তাহলে আমরা আবারও কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডে যে নিরাপত্তা ত্রুটি, সেই ত্রুটি যদি দূর করা না হয়, বিশেষ করে আমাদের নারী ইন্টার্নিদের নিরাপত্তায় যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো। কারণ, নিজেদের নিরাপত্তা না থাকা অবস্থায় অন্যদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব না।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের এই আন্দোলন স্থগিত হওয়ায় এখন হাসপাতালে স্বাভাবিক কার্যক্রম এবং কলেজের ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হবে। হাসপাতালে থাকা রোগীদের দুর্ভোগের শেষ হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে। গত কয়েকদিন ধরে চলা আন্দোলনে সাধারণ রোগীরা হয়ে পড়েছিলেন জিম্মি। আন্দোলনকারীরা জরুরি বিভাগ, আইসিইউ ও হৃদরোগ বিভাগ ছাড়া অন্য কোনো রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করেননি। তাদের আন্দোলনে সাধারণ রোগীদের ভোগান্তির বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার আজবাহার আলী শেখ সিলেটভিউকে জানিয়েছেন, দিব্য সরকারের রিমান্ড চাওয়া হবে না। তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হবে।
যা হলো আন্দোলনে>>
জানা গেছে, ওসমানী মেডিকেল কলেজের এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের সঙ্গে গত রোববার রাতে বাগবিতণ্ডা হয় এক রোগীর দুই স্বজনের। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অভিযোগ, বহিরাগতরা নারী চিকিৎসকের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। ইন্টার্ন চিকিৎসকরা সংঘবদ্ধ হয়ে ওই দুজনকে পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিষয়টির মীমাংসা হয়।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ধর্মঘটের ডাক দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তারা হাসপাতালের সব বিভাগে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন অসুস্থরা। এ ছাড়া কলেজের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করেন ইন্টার্নরা। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। এদিকে, সোমবার দিবাগত রাত ১টার দিকে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়াকে নিজ কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। প্রায় ঘন্টাখানেক অবরুদ্ধ ছিলেন তিনি।
গত সোমবার রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী শাহ অসিম ক্যানেডি বলেন, ‘রোববার এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীর দুই স্বজন খারাপ ব্যবহার করেন। তাদেরকে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দেই। এ ঘটনার জেরে সোমবার রাত ৮টার দিকে কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে বহিরাগতরা আমাদের কয়েক শিক্ষার্থীকে মারধর করে। এতে দুজন গুরুতর আহত হন। এর আগেও অনেকবার এমন ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।’
ধর্মঘট ও অবরোধের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান এসএমপির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এ ছাড়া হাসপাতালে যান সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন। হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে বসে বৈঠক। রাজনীতিবিদ, প্রশাসনের কর্মকর্তা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে।
শিক্ষার্থীরা মেডিকেল কলেজে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, হামলাকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মেডিকেল প্রশাসনের মামলা করাসহ পাঁচ দাবি জানান। তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। এরপর মঙ্গলবার ২টা পর্যন্ত ধর্মঘট ও অবরোধ প্রত্যাহার করেন আন্দোলনরতরা। তবে তাদের দাবি আদায় না হওয়ায় গত মঙ্গলবার ২টার পর থেকে ফের আন্দোলন শুরু হয়।
মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, পুলিশ প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের নেতারা বৈঠকে বসেন। বৈঠকে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খানও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু সব আসামিকে গ্রেফতার না হওয়া অবধি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা।
গতকাল বুধবারও আন্দোলন অব্যাহত ছিল। আন্দোলনকারীরা সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন, সড়ক অবরোধ করেন। এতে রোগীদের সাথে সাথে পথচারী সাধারণ মানুষও চরম দুর্ভোগে পড়েন। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে আন্দোলন বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা অবধি স্থগিতের ঘোষণা দেন ইন্টার্নিরা। এর মধ্যে আসামি গ্রেফতার না হলে হাসপাতালের সব বিভাগে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করার হুমকি দেন তারা।
দুই মামলা>>
গত মঙ্গলবার বিকালে নগরীর কোতোয়ালী থানায় দুটি মামলা হয়। পৃথক দুই মামলায় আসামি করা হয় ৮ জনকে। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ হানিফ ও ওসমানী মেডিকেল কলেজের পিএ-টু প্রিন্সিপাল ও সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাহমুদুল রশিদ বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন।
মামলার আসামিরা হলেন- দিব্য সরকার, আব্দুল্লাহ, এহসান আহমদ, মামুন, সাজন, সুজন, সামি ও সাঈদ হাসান রাব্বি।
এদের মধ্যে নগরীর মুন্সিপাড়ার মৃত রানা আহমদের ছেলে সাঈদ হাসান রাব্বি (২৭) ও কাজলশাহ এলাকার আব্দুল হান্নানের ছেলে এহসান আহমদকে (২২) গত সোমবার দিবাগত রাত ১টার দিকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। এ দুজনই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। তন্মধ্যে সাঈদ হাসান রাব্বি সিলেট মহানগরীর ৩ নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। এরপর কাল রাতে গ্রেফতার করা হলো দিব্য সরকারকে।
হচ্ছে পুলিশ ক্যাম্প>>
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ লক্ষ্যে মেডিকেল কলেজের কাছে একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, ‘ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যাম্পের জন্য একটা জায়গা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পুলিশ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। পুলিশের টহল বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আনসার বাহিনীর সদস্যদেরও বৃদ্ধি করার চেষ্টা চলছে। পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে আশা করি নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে।’
শেয়ার করুন