মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থানার ওসি মো. গোলাম আপছারকে চতুর্থ দফায় বদলি করা হয়েছে। এবার সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি’র নির্দেশে তাকে হবিগঞ্জ জেলায় বদলি করা হয়। এর আগেও তাকে দুই দফায় বদলি করা হলেও রহস্যজনক কারণে তিনি কুলাউড়া থানায় বহাল তবিয়তে থাকেন। এ নিয়ে পুলিশ প্রশাসনসহ সমগ্র জেলা ও দেশে অনেকেই সমালোচনা শুরু করেন।
জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার (৯ জুলাই) প্রথমে পুলিশ সুপার এম, কে, এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন স্বাক্ষতির চিঠিতে কুলাউড়া থানার ওসি মো. গোলাম আপছারকে তৃতীয় বারের মতো পার্শ্ববর্তী বড়লেখা থানায় বদলি করা হয়। তবে বদলির পরদিন বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মো. মুশফেকুর রহমান তাকে হবিগঞ্জ জেলায় বদলি করেন।সূত্র জানায়, ওসি গোলাম আপছারের বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের তদন্ত করেন সিলেট রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়ের পুলিশ সুপার (অপারেশন অ্যান্ড ট্রাফিক) মো. আমিনুল ইসলাম।
অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাকে হবিগঞ্জে বদলি করা হয়।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৪ ডিসেম্বর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে সিলেট রেঞ্জের বিভিন্ন থানার ওসিসহ কুলাউড়া থানার ওসি গোলাম আপছারকে টুরিস্ট পুলিশে বদলি করা হয়। এরপর গত ১২ মে সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি’র কার্যালয় থেকে কুলাউড়া ও রাজনগর থানার ওসিকে অন্যত্র বদলির জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে আরেকটি পত্র প্রেরণ করা হয়। সেই পত্রের ভিত্তিতে গত ১৭ মে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অ্যাডিশনাল আইজি (প্রশাসন) মো. মতিউর রহমান শেখ স্বাক্ষরিত পত্রে কুলাউড়া থানার ওসি মো. গোলাম আপছারকে প্রত্যাহারপূর্বক অন্যত্র বদলির অনুমতি প্রদান করা হয়।
বদলি করা হলেও রহস্যজনক ক্ষমতার প্রভাবে সেই আদেশও বাতিল হয়ে যায়। তবে এবার ডিআইজি’র সরাসরি হস্তক্ষেপে দ্রুত তাকে জেলা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।একটি সূত্র জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউর হন ওসি গোলাম আপছার জেলা পুলিশ সুপার এম, কে, এইচ জাহাঙ্গীর হোসেনের স্ত্রীর মামাতো ভাই। বিগত সময়ে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর হোসেনের অধীনে পিবিআইয়ে ওসি হিসেবে চাকরি করেন গোলাম আপছার। সেই সুবাদে থানায় মামলা বাণিজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা ও নানা অনিয়ম করায় জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ওসির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দায়ের করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১ মার্চ (শনিবার) সন্ধ্যায় সীমান্তবর্তী শরীফপুর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে চোরাকারবারির দ্বন্দ্বে নিহত হন দত্তগ্রামের বাসিন্দা রহমত আলীর ছেলে জাবেল মিয়া। এ ঘটনায় নিহতের পিতা রহমত আলী বাদী হয়ে পৃথিমপাশা ইউনিয়নের আমুলী গ্রামের চিহ্নিত চোরাকারবারি সুমন মিয়া, জাবের, শামীমসহ ১২ জনকে অভিযুক্ত করে এজাহার দিলেও ওসি গোলাম আপছার সুমন গংয়ের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ওই মামলার এজাহার থেকে তাদের নাম বাদ দেন। ওইসময় নিরুপায় হয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাননি নিহতের পিতা রহমত আলী। তবে রেঞ্জ ডিআইজি’র কার্যালয়ে ওসির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত চলাকালে মামলার বাদী রহমত আলী সশরীরে হাজির হয়ে ওসির বিরুদ্ধে সাক্ষি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
নিহত জাবেলের পিতা রহমত আলী বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলেকে চিহ্নিত চোরাকারবারি সুমন, জাবের, শামীম গং মিলে হত্যা করল। এ ঘটনায় তাদেরকে অভিযুক্ত করলেও ওসি টাকার বিনিময়ে তাদের নাম এজাহার থেকে বাদ দেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মূল হোতারা এখনো ধরা পড়েনি। তাই ডিআইজি অফিসে গিয়ে ওসির বিরুদ্ধে সাক্ষি দিয়েছি।’
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে কুলাউড়া থানার ওসি হিসেবে যোগদান করেন গোলাম আপছার। ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে তিনি তার নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা যেসব এসআই ও এএসআই থানায় কর্মরত রয়েছেন তাদেরকে নিয়ে শক্ত একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। যার কারণে থানার অন্য পুলিশ সদস্যদের সবসময় তটস্থ থাকতে হয়। এদিকে ওসির মতের বিরুদ্ধে যাওয়ায় পুলিশ সুপারকে দিয়ে ইতিমধ্যে থানা থেকে পাঁচ থেকে ছয়জন পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড করানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এসআই বলেন, ওসি আপছার টাকার জন্য বেপরোয়া ছিলেন। বিগত সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দুটি মামলায় অন্তত ২০-২৫ জন নির্দোষ লোককে স্থানীয় একটি চক্রের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে তাদের গ্রেপ্তারও করেছেন। ওসির মতের বাইরে যাওয়ায় তিনি পুলিশ সুপারকে দিয়ে কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই আমাদের কয়েকজনকে ক্লোজড করিয়েছেন। একপর্যায়ে ডিআইজি কার্যালয় থেকে ওসির বিরুদ্ধে চলা তদন্তে থানার ১২ জন পুলিশ সদস্য সাক্ষিও দিয়েছেন।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী দুটি মামলায় আওয়ামী লীগের দোসর বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেনু, যুগ্ম সম্পাদক সাবেক পৌর মেয়র সিপার উদ্দিন আহমদসহ দলের শীর্ষ নেতাকর্মীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। উল্টো পলাতক আসামিদের কাছ থেকে মাসোহারা হিসেবে ওসি নিয়মিত মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। পৃথিমপাশা ইউনিয়নে তানিম নামক এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল) কামরুল হাসান এবং ওসি গোলাম আপছারের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হলে ওসি কৌশলে প্রভাব খাটিয়ে কামরুল হাসানকে প্রায় দেড় মাস আগে বদলি করান।
সম্প্রতি হাজীপুর ইউনিয়নে প্রশাসন কর্তৃক প্রায় ২৭ কোটি টাকার বালু জব্দ করায় ও অবাধে ১০ চাকার গাড়ি দিয়ে বালু পরিবহনে রাস্তার ক্ষতি হলে স্থানীয় লোকজন প্রতিবাদ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে হবিগঞ্জের যুবলীগ নেতা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক মামলার আসামি সেলিম আহমদের স্ত্রী ইজারাদার নাজমুন নাহার স্থানীয় বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নেতাকর্মীসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেন। সেই মামলা হওয়ায় স্থানীয়ভাবে অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
কুলাউড়া থানার ওসি মো. গোলাম আপছার বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক নয়। তদন্তে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।’
তাহলে কোন অভিযোগের ভিত্তিতে বদলি করা হলো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে বদলি করেছেন, সরকারি চাকরি করি যেহেতু সেই আদেশ তো মানতে হবে। শরীফপুরে নিহত জাবেল হত্যা মামলায় বাদী যেভাবে এজাহার দিয়েছেন সেভাবে মামলা রুজু করা হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের পলাতক শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি কুলাউড়ায় যোগদান করার পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছি।’সিলেট রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়ের পুলিশ সুপার (অপারেশন অ্যান্ড ট্রাফিক) মো. আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওসি গোলাম আপছারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত করে প্রতিবেদন ডিআইজি মহোদয়ের কাছে জমা দিয়েছি।’
জেলা পুলিশ সুপার এম, কে, এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওসি আপছার আমার কোনো আত্মীয় নন। ওসির বদলির বিষয়টি হলো রুটিন ওয়ার্ক।’
শরীফপুরের জাবেল হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের নাম ওসি কেন বাদ দিলেন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাদীর সঙ্গে কথা বলেন এবং বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। পুলিশের কাছে সেবা নিতে আসা জনগণকে যদি কোনো পুলিশ সদস্য হয়রানি করে থাকেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী মামলায় যদি নির্দোষ কাউকে আসামি করা হয় তাহলে তদন্তপূর্বক চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তাদের নাম বাদ দেওয়া হবে।’