কত টাকা থাকলে কোরবানি দিতে হবে?

ইসলাম ও জীবন

ইসলামে কোরবানির গুরুত্ব অনেক। এটি একটি মৌলিক ইবাদত। পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী হজরত আদম (আ.) থেকে শরু করে সব যুগে কোরবানি ছিল। তবে তা আদায়ের পন্থা এক ছিল না। শেষ নবী হজরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর উম্মতের জন্য কোরবানি ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। সেখান থেকেই এটি এসেছে।

কোরবানি শাআইরে ইসলাম তথা ইসলামের প্রতীকী বিধানগুলোর একটি। এর মাধ্যমে শাআইরে ইসলামের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পাশাপাশি গরিব-দুঃখী ও প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়। আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে কোরবানিতে। একই সঙ্গে আল্লাহ তাআলার জন্য ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষাও আছে এতে।
পবিত্র কোরআনে কয়েকটি স্থানে কোরবানি প্রসঙ্গ এসেছে। কোরবানি করার সরাসরি নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘সুতরাং আপনার রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউসার, আয়াত: ২)

আল্লাহর রাসুল (সা.) তার মদিনার জীবনে প্রতিবছর কোরবানি করতেন। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করছিলেন, প্রতিবছর তিনি কোরবানি করেছেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩১২৭)

কোরবানির ফজিলত
উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলু (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির দিনের আমলগুলোর মধ্য থেকে পশু কোরবানি করার চেয়ে কোনও আমল আল্লাহ তাআলার কাছে অধিক প্রিয় নয়। কেয়ামতের দিন এই কোরবানিকে তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ তাআলার কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি করো।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস: ১৪৯৩)

কোরবানি না করলে হুঁশিয়ারি
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করে না, তার ব্যাপারে হাদিস শরিফে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যার কোরবানির সামর্থ্য আছে, তবু সে কোরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (মুসনাদে আহমদ ২/৩২১)

কার ওপর কোরবানি ওয়াজিব
প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন কোনও পুরুষ কিংবা নারী যদি ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব।

হিসাবযোগ্য পণ্য
কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য পণ্য হলো— টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলংকার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না, এমন জমি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাব।

আর নেসাবের পরিমাণ হলো— স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৮৭ দশমিক ৪৮ গ্রাম) ভরি, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে ৫২ (৬১২ দশমিক ৩৬ গ্রাম) ভরি এবং টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হলো— এর মূল্য সাড়ে ৫২ ভরি রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হতে হবে।

সোনা বা রুপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনও একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।

গত ২৮ মে (মঙ্গলবার) বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) দর অনুযায়ী ৫২ দশমিক ৫ তোলা ২২ ক্যারেট রুপার দাম হলো ৮৮ হাজার টাকার মতো। (এখানে অলংকার হিসেবে দাম ধরা হয়নি। কারণ, এ ক্ষেত্রে অলংকার তৈরির মজুরি অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু কোরবানি ওয়াজিব হয় শুধু রুপার ওপর। এ জন্য রুপার বিস্কুটের দাম ধরা হয়েছে)। তবে কোরবানি ওয়াজিব হয় ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সাড়ে ৫২ ভরি রুপার যে দাম থাকবে, তার ওপর ভিত্তি করে।

কোরবানির পশু কেমন হবে
কোরবানির পশু দোষ-ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। পশুর যেসব দুর্বলতার কারণে কোরবানি দেওয়া যাবে না, তা এখানে তুলে ধরা হলো—অন্ধ, বধির, অত্যন্ত দুর্বল ও জীর্ণ-শীর্ণ, জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে অক্ষম, লেজের বেশির ভাগ অংশ কাটা, জন্মগতভাবে কান না থাকা, কানের বেশির ভাগ কাটা, গোড়াসহ শিং উপড়ে যাওয়া, পাগল হওয়ার কারণে ঘাস-পানি ঠিকমতো না খাওয়া, বেশির ভাগ দাঁত না থাকা, রোগের কারণে স্তনের দুধ শুকিয়ে যাওয়া, ছাগলের দুটি দুধের যেকোনও একটি কাটা হওয়া, গরু বা মহিষের চারটি দুধের যেকোনও দুটি কাটা হওয়া।

কোরবানি পশুর বয়স
উট কমপক্ষে পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি এক বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট যে দেখতে এক বছরের মতো মনে হয়, তাহলে তা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাস বয়সী হতে হবে। তবে ছাগলের বয়স এক বছরের কম হলে তা দ্বারা কোরবানি জায়েজ হবে না। আর নর-মাদা উভয় পশুই কোরবানি করা যায়।

এক পশুতে কতজন শরিক হতে পারবে
একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কোরবানি দিতে পারবেন। এমন একটি পশু দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে কোরবানি করলে কারোরই সহি হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারবে। সাতের অধিক শরিক হলে কারও কোরবানি সহি হবে না।

হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমাদের নির্দেশ করেছেন যে আমরা একটি গরু এবং একটি উটে সাতজন করে শরিক হয়ে যাই। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১৮) আর সাতজনে মিলে কোরবানি করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারও অংশ এক সপ্তমাংশের কম হবে না। যেমন: কারও আধা ভাগ, কারও দেড় ভাগ—এমন হলে কোনও শরিকের কোরবানি সহি হবে না। তবে একজন একাধিক ভাগ নিতে পারবেন।

কোরবানির পশুতে আকিকা হবে কি
কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে শরিক হওয়া যাবে। এতে কোরবানি ও আকিকা দুটোই সহি হবে। ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ দিতে হবে। শৈশবে আকিকা করা না হলে বড় হওয়ার পরও আকিকা করা যাবে। যার আকিকা সে নিজে এবং তার মা-বাবাও আকিকার মাংস খেতে পারবে। কোনও হাদিসে কোরবানির সঙ্গে আকিকা করতে নিষেধ করা হয়নি; বরং কোরবানির সঙ্গে হজে কোরবানি, জরিমানা দম একত্রে এক পশুতে দেওয়ারও প্রমাণ আছে।

কোরবানির মাংস তিন ভাগ করা কি জরুরি
কোরবানি করা এবং কোরবানির মাংস দান করা ভিন্ন দুটি আমল। সওয়াবের নিয়তে পশু জবাইয়ের দ্বারা কোরবানির ওয়াজিব আদায় হয়ে যায়। আর কোরবানির মাংস বিতরণের ব্যাপারে ইসলামে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তবে তা বিতরণে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং দান করলে সওয়াব পাওয়া যাবে।

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা (কোরবানির মাংস) খাও, জমা করে রাখো এবং গরিব-অসহায়দের দান করো।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস: ১৯৭১)। কিন্তু উত্তম হলো, মাংস তিন ভাগে ভাগ করে এক অংশ আত্মীয়দের ‘উপহার’ দেওয়া, এক অংশ গরিবদের দেওয়া এবং আরেক অংশ নিজে ও পরিবার-পরিজনের জন্য রাখা। আল্লাহর রাসুল (সা.) এটিই করতেন। (আল মুগনি, ১৩/৩৭৯)

তথ্যসূত্র: বাদায়েউস সানায়ে, মুয়াত্তা মালেক, ফতোয়ায়ে কাজিখান, আলমুহিতুল বুরহানি, ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া ইত্যাদি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *