গত ৯ মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৪০ শতাংশের বেশি কমেছে। পাশাপাশি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দামও কমেছে ৮১ শতাংশ। কিন্তু বিশ্ববাজারের দামের প্রভাব দেশের বাজারে নেই। যদিও দেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয় করা হবে।
কিন্তু বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম কমলেও জ্বালানি বিভাগ স্থিতিশীল নয় বলে অজুহাত দেখাচ্ছে। ফলে দেশেল বাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম কমছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) দেশে জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহ কার্যক্রমের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। সংস্থাটি জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে। একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে জ্বালানি বিভাগ বিপিসির লাভ-লোকসানের হিসাব আমলে নিয়ে মূল্য সমন্বয়ের ঘোষণা দেয়। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট তৈরি হয়। এর ৬ মাসের মাথায় পণ্যটির দাম এক লাফে ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। হু হু করে এলএনজির দামও বাড়তে থাকে। ফলে কয়েক দফা দেশের বাজারেও তাই জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। এর মধ্যে তিন দফা দাম সমন্বয় করে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি বেড়েছে ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অকটেনে লিটারপ্রতি ৫১ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং পেট্রলে লিটারপ্রতি ৩১ দশমিক ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। মূল্য সমন্বয়ের পর বর্তমানে ডিজেল ও কেরোসিন লিটারপ্রতি দাম ৬৫ থেকে বেড়ে ১০৯ টাকা হয়েছে। এর মধ্যে দু’দফা দাম বেড়েছে আর এক দফা কমেছে। তাছাড়া অকটেন লিটারপ্রতি ৮৯ থেকে বেড়ে ১৩০ টাকা এবং পেট্রল লিটারপ্রতি ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ টাকা করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ, বৃহৎ শিল্পে ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং মাঝারি শিল্পের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তিন দফায় ১৫ শতাংশ (প্রতিবার ৫ শতাংশ করে) বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। তার মধ্যে এক দফায় বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়।
সূত্র জানায়, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ায় দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের মূল্যও লাফিয়ে বাড়ে। বেড়েছে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশেও সমন্বয় করা হয়েছে। দাম কমলে তা আবারো সমন্বয় করা হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম কমলেও সরকার আর ওই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করছে না। আর সরকার যদি জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমানোর পরিকল্পনাও করে, তাতে সুফল পাবে না ভোক্তা। কারণ জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে অন্য জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। তাছাড়া ভর্তুকি ও লোকসান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা কমাতে আইএমএফের শর্তের প্রতিও সরকার দায়বদ্ধ।
সূত্র আরো জানায়, দেশের বাজারে এখনই জ্বালানি তেল কিংবা গ্যাসের দাম কমানোর পরিকল্পনা সরকারের নেই। সরকার মূলত ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেশকিছু শর্তও রয়েছে। সেজন্য জ্বালানির দাম কমানোর পরিবর্তে বরং আরো কয়েক দফা গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে। আইএমএমের ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নানা ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনার মাধ্যমে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা বাড়ানো। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ব খুব দ্রুতই শুরু হতে যাচ্ছে। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ে একটি সময়ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করতে হবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম কমলেও দেশের ভোক্তারা এর সুফল যে পাচ্ছে না তা অনেকটাই নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে আইএমএফের শর্তই প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে।
এদিকে বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ জানান, বিপিসি বাজার পর্যালোচনা করছে। তবে এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর মতো পরিস্থিতি আসেনি। এ বিষয়ে পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হবে।
শেয়ার করুন