সবকিছুই শেষ। বলতে গেলে এখন আমার আর কিছুই নেই। আমি ২০ কেজি ধানের বীজতলা করেছি। সেই বীজতলার চারা ১৩০ শতাংশ জমিতে লাগিয়েছি। সব পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে, কিছুই নেই। ১৭ শতাংশ জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেছি। ক্ষেতে এত ভালো সবজি ছিল, পানিতে সব শেষ। সব হারিয়ে ফেলেছি। দুশ্চিন্তায় এখন ঠিকমতো ঘুমও আসে না। এ ছাড়া ঘরের দরজা পর্যন্ত পানি। কোনো রকম পরিবার দিয়ে আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন। চাষাবাদ নিয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা কৃষক আবদুর রাজ্জাক কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন।
এদিকে চাষাবাদ করতে না পেরে চলতি মৌসুমে দেড় লক্ষাধিক কৃষকের উপার্জনও বন্ধ হয়ে গেছে। পানিতে বীজতলাসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়ে তাদের অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এতে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছেন কৃষকরা। কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
জানা গেছে, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্দি হয়ে আছে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, মান্দারী, দত্তপাড়া, বাঙ্গাখাঁ, চন্দ্রগঞ্জসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা। প্রথম দিকে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পানিতে ডুবে যায় ক্ষেত-খামার, গ্রামীণ রাস্তাসহ মানুষের বসতঘর। এরমধ্যে নোয়াখালী থেকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে লক্ষ্মীপুরে। এতে পানি দ্বিগুণ উচ্চতা ধারণ করে। ডুবে যায় মাঠ-ঘাট, রাস্তা, বসতঘর ও ফসলি জমিগুলো। মাস পার হলেও কমছে না পানি। কোথাও কোথাও দুই মাস ধরেই পানিতে ডুবে আছে বিস্তীর্ণ জনপদ। এখন আর চাষাবাদের সময়ও নেই। বন্যা আর জলাবদ্ধতার পানিতে আবাদকৃত জমি ডুবে ১ লাখ ৫৭ হাজার ২০৯ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে বীজতলাসহ ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে তাদের ২২৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
অন্যদিকে সবজি উৎপাদনের উর্বর এলাকা হিসেবে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের খ্যাতি রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত সবজি লক্ষ্মীপুরের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। কিন্তু এবার পানিবন্দি হয়ে এ অঞ্চলের কৃষকদের চাষাবাদকৃত ধান ও সবজি গাছগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ফসলি ক্ষেতগুলো এখন পানিতে ডুবে আছে। যে মাঠে ধান গাছ বাতাসে দোলা দিত, যে ক্ষেতেগুলো শসা, করলা, মিষ্টি কুমড়ো, টমেটো ও লাউসহ বিভিন্ন শাক-সবজিতে সবুজ হয়ে থাকতো, তা এখন পানিতে ভরপুর হয়ে নদীতে পরিণত হয়েছে। কবে কমবে পানি তা নিয়েই দিন গুণছেন কৃষকরা। তারা এমন পরিস্থিতির শিকার আর হতে চান না বলে জানিয়েছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন, যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে পানি নেমে যায়। তা না হলে তাদের ভবিষ্যৎ শূন্য হয়ে দাঁড়াবে।
১২০ শতাংশ জমিতে সবজি ও ধান আবাদ করেন চরমনসা গ্রামের আবুল হাশেম। তার কাছে থাকা অধিকাংশ অর্থই তিনি আমন ধান ও শাকসবজি আবাদে খরচ করে ফেলেছেন। কিন্তু পানিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো জমিতে প্রায় বুক পরিমাণ পানি রয়েছে। এক মাসের ওপর পানিবন্দি থেকে সংসারেও অভাব দেখা দিয়েছে। ধীরে ধীরে না খেয়ে মরার দশা সৃষ্টি হচ্ছে। এমন অবস্থায় সরকারিভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা না হলে এ অঞ্চলের কৃষকদেরকে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বলে জানিয়েছেন হাশেম।
সদর উপজেলা ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরমনসা গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, এ জমিতে শসা, করলা, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করা হয়েছে। পানি সব নিয়ে গেছে। এখন মাচায় গাছের শুকনো লতাপাতা জড়িয়ে আছে। একেকজন কৃষকের লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রায় কোটি টাকার সবজি উৎপাদন হতো এখানে। যদি খরা হয়, তখন আবার চাষাবাদ করা যাবে। এর আগে আর কোনো সুযোগ নেই। আর একটা মৌসুম চাষাবাদ না করতে পারার ক্ষতি প্রতিটি মৌসুমে ভুগবে কৃষকরা।
চরমনসা গ্রামের কৃষক মো. নুরুজ্জামান বলেন, প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে আমন ধানের চারা লাগিয়েছিলাম। পানিতে সব ভেসে গেছে। এখনো ক্ষেতে কোমরসমান পানি। এ মৌসুমে আর চাষ করা সম্ভব নয়। আমাদের দিকে কেউই তাকায় না।
পশ্চিম চরমনসা গ্রামের আবুল কালাম বলেন, একে এক তিনবার ধানের চারা রোপণ করেছি। তিনবারই সব পানিতে শেষ হয়ে গেছে। হাজার হাজার কৃষক রয়েছে। সরকার যদি আমাদেরকে সহযোগিতা করে, তাহলে আমাদের উপকার হবে।
দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের কৃষক মো. নুর নবী বলেন, ঘরের ভেতর দেড় থেকে দুই ফুট পানি ছিল। ক্ষেতে প্রায় চার ফুটের ওপর পানি ছিল। এখনো দুই থেকে আড়াই ফুটের মতো পানি আছে। আমাদের বীজতলা ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। গাছপালা সব মরে গেছে। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। আমাদের সম্পদ বলতে এখন শুধু আছে কাঁতা-বালিশ আর ঘরবাড়ি।
দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের আরেক কৃষক নুর মোহাম্মদ বলেন, দুই বার বীজতলা করেছি। সব পানিতে পচে গেছে। জমিতে পানিতে টইটম্বুর। কোনোভাবেই এবার আর চাষাবাদ করার সুযোগ নেই। মাস পার হলেও পানি শুকায়নি। উলটো বৃষ্টিতে পানি বেড়ে গেছে। আগামী দুই মাসেও মাঠের পানি নামবে বলে মনে হয় না।
সদরের পশ্চিম দিঘলী গ্রামের বাসিন্দা রফিক উল্যা বলেন, দুইবার বীজতলা করেছি। প্রথমবার বীজতলা বৃষ্টির পানি জমে পচে গেছে। পরেরবার নোয়াখালী থেকে বন্যার পানি এসে বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষেতের দিকে তাকালে এখন সাগর মনে হয়।
পূর্ব দিঘলী গ্রামের ওয়াপদা বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা মনির আহম্মদ বলেন, ২০ কেজি ধানের বীজতলা করেছি। চারা রোপণের আগমুহূর্তে পানিতে সব শেষ হয়ে গেছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ বলেন, লক্ষ্মীপুরে বন্যায় কৃষিখাতে প্রায় ২২৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। সরকার প্রণোদনার প্যাকেজ দিচ্ছে। তা আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে বিতরণ করে আসছি। ইতোমধ্যে ছয় হাজার কৃষকের মাঝে আমন ধানের বীজ ও সার বিতরণ করা হয়েছে। তাদের ব্যাংক হিসেবে ১ হাজার টাকা করে সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ৬৫ হাজার কৃষকের জন্য শীতকালীন সবজির প্রণোদনা চাহিদা পাঠিয়েছি। বরাদ্দ পেলে কৃষকদের মাঝে তাও বিতরণ করা হবে। ফসলি ক্ষেতগুলোতে প্রচুর পানি জমে আছে। পানি শুকাতে আরও কিছু সময় লাগবে। এ ক্ষতির রেশ কাটতেও কৃষকদেরকে অনেকদিন সময় লাগবে।
তিনি আরও বলেন, আগাম রবি মৌসুমের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ আমরা বুঝে পেয়েছি। ১৩ হাজার ২০০ কৃষকের মাঝে গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমূখী, মুগ, মশুর, খেসারি, চিনা বাদাম, সয়াবিন ও শীতকালীন পেঁয়াজ বীজ বিতরণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, লক্ষ্মীপুরে চলতি মৌসুমে ৩ হাজার ৬০৭ হেক্টর জমিতে আমনের বীজতলা তৈরি করা ছিল। বন্যা, জলাবদ্ধতা ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে ২ হাজার ৫৩৬.৮০ হেক্টর জমির বীজতলা পচে নষ্ট হয়ে গেছে। ৭০ ভাগের বেশি বীজতলা নষ্ট হয়ে ৬৩ হাজার ৪২০ জন কৃষকের ২৯ কোটি ২৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। রোপা আমনের আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৩৯৪ হেক্টর জমিতে। পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে ৭ হাজার ৬১০.৭০ হেক্টর জমির ফসল। আবাদকৃত জমির ৫৩ ভাগ রোপা আমন নষ্ট হয়ে ৩১ হাজার ৭০৬ জন কৃষকের ৮৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ২৪ হাজার ৪২৩ জন কৃষকের ৪ হাজার ৭০.৫০ হেক্টর জমির আউশ ধান নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ৩৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকার। বোনা আমনে ৯ হাজার ৭২০ জন কৃষকের ১ কোটি ২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জেলা কৃষি বিভাগ আরও জানায়, বন্যায় ১০ হাজার ৩৯০ হেক্টর জমির শরৎকালীন শাক-সবজি নষ্ট হয়েছে। আবাদকৃত জমির শতভাগ শাক-সবজি নষ্ট হয়ে ২০ হাজার ৭৮০ জন কৃষকের ৫১ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ১১২.২ হেক্টর জমির পান নষ্ট হয়ে ১ হাজার ৬৬৩ জন কৃষকের ক্ষতি হয়েছে ১৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকার। ২৪০ জন কৃষকের ৮৩.৩৩ হেক্টর জমির আদা নষ্ট হয়ে ৭০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। ৩৯ হেক্টর জমিতে থাকা ৯৮ মেট্রিক টন হলুদ নষ্ট হয়ে ২ হাজার ৪০ জন কৃষকের ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। ৭৪৪ জন কৃষকের ৯.৩ হেক্টর জমির আখ নষ্ট হয়ে ক্ষতি হয় ২ কোটি ৯ লাখ টাকা। ২ হাজার ৭৩ জন ফল চাষির ৪১.৪৬ হেক্টর জমির ফল বাগান নষ্ট হয়ে ২০৭ মেট্রিক টন ফলের ক্ষতি হয়েছে। যার বাজার মূল্য ২ কোটি ৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
শেয়ার করুন