জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। জাকাত সামর্থ্যবান লোকদের ওপর বছরে একবার ফরজ। সম্পদ যত পরিমাণই হোক মাত্র আড়াই শতাংশ জাকাত প্রদেয়। জাকাতের বিধান অনেকেই ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। বিশেষত, ঋণের জাকাতের বিধান একদমই অনালোচিত। তাই সে বিষয়টিই আজ আমরা জানার চেষ্টা করব।
অন্যকে ঋণ দেওয়া অর্থের ব্যাপারে বিধান হলো, টাকা হাতে না আসা পর্যন্ত সেই সম্পদে জাকাত ফরজ হবে, তবে এখনই তা আদায় করা আবশ্যক নয়। বরং উক্ত টাকা হাতে পাওয়ার পর জাকাত আদায় করা আবশ্যক। কেননা সম্পদ তো জাকাত দাতার হাতে নেই। তবে সেই অর্থ হাতে আসার পর পেছনের বছরের কাজাসহ আদায় করতে হবে। যার কাছে ঋণের টাকা পাবেন তিনি সম্পদশালী হলে এবং ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে কোনোরূপ টালবাহানা করার সম্ভাবনা না থাকলে জাকাতদাতা ইচ্ছা করলে চলমান জাকাতের সঙ্গে সেই ঋণের জাকাতও পরিশোধ করে দিতে পারেন। এতে তার জিম্মা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। অন্যথায় তা পাওয়ার পর হিসাব করে বিগত প্রত্যেক বছরের জাকাতও আদায় করতে হবে। কেননা তা সম্পদশালী লোকের হাতে ছিল। আর তা তলব করাও সম্ভব ছিল। সুতরাং ঋণদাতার ইচ্ছাতেই তলব করতে দেরি করা হয়েছে। এভাবে অগ্রিম পরিশোধ করলে পরবর্তী সময়ে সেই ঋণ পাওয়ার পর কাজা আদায়ের ঝামেলায় যাওয়া লাগবে না।
একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক। আব্দুল্লাহ ২০১৪ সালে আব্দুর রহীমকে ৬০,০০০/= ধার দিয়েছেন। ২০১৭ সালে সে আব্দুর রহীমের কাছ থেকে তার পাওনা উসুল করতে পেরেছেন। এখন তিনি পেছনের বছরের কাজা আদায় করতে চাচ্ছেন। তাহলে তিনি অন্যান্য সম্পদের জাকাতের সঙ্গে ৬০,০০০/= টাকারও জাকাত আদায় করবেন। ২০১৪ সালে দেওয়া ৬০,০০০/= টাকায় ২০১৫ সালে জাকাত এসেছে ১,৫০০/= (এক হাজার পাঁচশত টাকা) ১৬ সালে আবার এসেছে ১,৫০০/= এবং ১৭ সালে আবার এসেছে ১,৫০০/=। তাই ১৭ সালে আব্দুল্লাহর ঋণের জাকাত এসেছে সর্বমোট ৪,৫০০/= [চার হাজার পাঁচশত টাকা]। ১৭ সালে জাকাত প্রদান করার সময় তাকে তার অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পদের জাকাত প্রদানের পাশাপাশি ঋণের জাকাত ৪,৫০০/= প্রদান করতে হবে। তবে ১৭ সালে এক সঙ্গে কাজা আদায় না করে প্রতি বছরের জাকাত প্রদানের সময়ে এই ঋণের জাকাতও দিয়ে দেওয়া যায়। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদিস ১০৩৪৭, ১০৩৫৬, মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদিস ৭১১৬,৭১২৯,৭১৩১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদিস ১০৩৪৬, ১০৩৫৬)
তবে যেসব ঋণ অভাবী লোকের হাতে থাকার কারণে উঠানোর সম্ভাবনা কম, বা ধনী লোকের হাতেই আছে তবে সে টালবাহানা করছে, সেসব ঋণের জাকাত অগ্রিম প্রদান করবে না।
আর যেসব ঋণ একেবারেই পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করে পাওয়া যায় সেসব ঋণ হস্তগত হওয়ার পর ওলামায়ে কেরামের কারো কারো মতে তখন থেকে নতুন করে বর্ষ গোনা শুরু করবে। আবার কেউ বলেন, বিগত এক বছরের জাকাত আদায় করবে এবং পরবর্তী বছর এলে আবার জাকাত আদায় করবে। এটাই অত্যধিক সতর্ক অভিমত।
স্বামীর কাছে স্ত্রী যে মোহরানা পায় তা হস্তগত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাতে জাকাত ফরজ হয় না। হস্তগত হওয়ার পর যদি মহিলার কাছে আগে থেকেই জাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ না থাকে তাহলে এখন থেকে নতুন করে বছর গোনা শুরু করবে। এক বছর পূর্ণ হলে জাকাত আদায় করবে। স্ত্রী মোহরানা পাওয়ার আগ থেকেই যদি নিসাব পরিমাণ টাকার মালিক থাকে তাহলে সদ্যপ্রাপ্ত মোহরানার টাকা অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে এবং পুরোনো সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের জাকাত প্রদান করতে হবে।
অন্যরা যে ঋণ পাবে
ঋণ সাধারণত দুই কারণে নেওয়া হয়ে থাকে। ক. মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য ঋণ নেওয়া। খ. ব্যবসায়িক সম্প্রসারণ বা উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য ঋণ নেওয়া। মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য ঋণ নিয়ে থাকলে তা জাকাতের অর্থ থেকে বাদ দেওয়া যাবে। এ ধরনের ঋণ সম্পদ থেকে বাদ দেওয়ার পর যদি নেসাব বাকি থাকে তবে জাকাত ফরজ হবে, অন্যথায় ফরজ হবে না। (মুয়াত্তা মালেক ১০৭; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস নং ৭০০৩, ৭০৮৬, ৭০৮৯, ৭০৯০, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৪৭- ৫৪৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/৮৩)
কিন্তু ডেভেলপমেন্ট লোন বা উন্নয়নমূলক ঋণ অর্থাৎ যেসব ঋণ ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য, ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার জন্য ভবন নির্মাণের উদ্দেশ্যে নিয়ে থাকে, তা জাকাতের অর্থ থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ এ ধরনের ঋণের কারণে জাকাত কম দেওয়া যাবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদিস ৭০৮৭)
বর্তমানে শিল্পপতিরাই এ ধরনের ঋণ বেশি নিয়ে থাকেন। ডেভলপমেন্ট ঋণ বাদ দিলে অনেক শিল্পপতি আছেন তাদের ওপর কোনো জাকাতই ফরজ হবে না। কারণ তাদের সম্পদের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি। স্ত্রীর মোহরানার টাকা স্বামীর ওপর ঋণ হলেও এই ঋণ জাকাতের সম্পদ থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। (রদ্দুল মুহতার ২/২৬১)
অন্যকে যে টাকা ঋণ দিয়েছে যা উঠে আসার সম্ভাবনা প্রবল বা ব্যবসায়ী বাকিতে যে পণ্য বিক্রি করেছে, সেসব টাকা জাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে মিলিতভাবে হিসাব করলে যদি নিসাব পূর্ণ হয় তাহলেও জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদিস ৭১১১-৭১১৩,৭১২১,৭১২৩,৭১২৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৪৮৪-৪৮৬)
শেয়ার করুন