কুরআনের আলোকে সুখি পরিবার

ইসলাম ও জীবন

পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বিবাহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয়েছে। এ ভিত্তির ওপরই দাম্পত্য জীবনের প্রাসাদ রচিত হয়।

যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার পরিবর্তে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা, মানসিক শান্তি ও স্বস্তি, তৃপ্তি, স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের আত্মীয়স্বজন ও বংশ পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসার ও সম্প্রীতির গভীর সম্পর্ক, মানবীয় সহানুভূতি সহৃদয়তা আবেগপূর্ণ সংবেদশীলতার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ এবং পিতামাতা হিসাবে সন্তানদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠা প্রভৃতিই হচ্ছে বৈবাহিক বন্ধনের আসল লক্ষ্য।

আল্লাহ পাক বলেন : ‘তার নিদর্শনাবলির মধ্যে ইহা একটি যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে জুড়ি সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাদের কাছে শান্তি-স্বস্তি লাভ করতে পার এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব স্বহৃদয়তার সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য এতে বহু চিন্তা বিবেচনার তত্ত্ব ও বিষয়াদি রয়েছে।’ (সূরা রুম-২১)।

স্ত্রীকে যেমন স্বামীর আনুগত্য ও তার মনোতুষ্টি বিধানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে স্বামীকেও স্ত্রীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার, নরম কোমল আচরণ করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীর সঙ্গে সদাচরণ এবং স্ত্রীর ভরণপোষণ ও সম্মানজনক জীবন ধারণের সুব্যবস্থা করার জন্যও স্বামীকে আদেশ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন; ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচরণ কর।’

(সূরা নিসা-১৯)। রাসূল (সা.) বলেছেন; ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের ভালো-মন্দের দিকে তথা কল্যাণের দিকে খেয়াল রাখবে। সাবধান! তারা তোমাদের দায়িত্বে ন্যস্ত। সাবধান! স্ত্রীদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, ঠিক তেমনি তোমাদের ওপর স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে। তোমাদের নিকট স্ত্রীদের প্রাপ্য অধিকার হচ্ছে, তোমরা তাদের সঙ্গে সদাচরণ করবে, তাদের ভরণপোষণ প্রদান করবে।

আর স্ত্রীদের কাছে তোমাদের প্রাপ্য অধিকার হচ্ছে, তারা তাদের সতীত্ব সম্ভ্রম তোমাদের জন্য সংরক্ষণ করবে এবং তোমাদের অবাঞ্ছিতদের তোমাদের ঘরে প্রবেশ করতে দেবে না। (ইবনে মাজাহ, তিরমিজি)। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই সর্বোত্তম ব্যক্তি, যে আপন পরিবার পরিজনদের কাছে সবচেয়ে বেশি উত্তম।’ (ইবনে হেব্বান)।

অপর এক বর্ণনায় আছে-‘রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যার চরিত্র ভালো, আর সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী, যে নিজ পরিবারের সঙ্গে অধিকতর কোমল আচরণকারী। (মনে রাখবে!) আমিই তোমাদের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে সর্বোত্তম কোমল আচরণকারী।’ রাসূল (সা.) বলেন; যে ব্যক্তি স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে সবর এখতিয়ার করবে, সে হজরত আইউব (আ.)-এর মতো পুরস্কার পাবে। আর যে মহিলা স্বামীর দুর্ব্যবহারে সবর করবে, সে ফেরাউনের বিদুষী স্ত্রী বিনতে মুজাহিমের (আছিয়া) মতো পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে।

স্ত্রীকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া যাবে না। সে যদি কোনো প্রকাশ্য নির্লজ্জতার কাজ করে বসে তবে তা স্বতন্ত্র কথা। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যা কিছু তোমাদের স্ত্রীদের দিয়েছ তার কোনো অংশ ফিরিয়ে পাওয়ার উদ্দেশ্যে তোমরা তাদের কষ্ট দিও না। তবে তারা যদি কোনো প্রকাশ্য নিলর্জ্জতার কাজ করে, তবে তা স্বতন্ত্র কথা।’ (আননিসা ১৯)। আর স্ত্রী যদি স্বামীর অপছন্দই হয় এবং সে নিজেই তাকে তালাক দিয়ে অপর কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক হয়ে থাকে, তাহলে স্ত্রীর কাছ থেকে কিছুই ফেরত নেওয়া জায়েজ হবে না।

আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা যখন এক স্ত্রীর স্থলে আর এক স্ত্রী গ্রহণ করার ইচ্ছা করে থাক আর তোমরা একজনকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ দিয়ে থাক, তাহলে তোমরা তা থেকে কিছুই গ্রহণ করতে পারবে না। তোমরা কি দোষারোপ করে ও সুস্পষ্টভাবে অধিকার হরণ করে তা গ্রহণ করতে চাও? আর তা তোমরা গ্রহণ করবেই বা কী করে? অথচ তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে দাবি আদায় করে নিয়েছ। আর তারা তোমাদের কাছ থেকে শক্ত ও কঠিন প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে।’ (সূরা নিসা-২০)।

মুসলিম স্বামী মাত্রই কর্তব্য তার স্ত্রীর ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করা। মানুষের মধ্যে মানবিক যেসব দোষ-ত্রুটি স্বাভাবিকভাবে থাকে তা নারী-পুরুষ দুজনের মধ্যেই থাকে। তাই স্ত্রীলোকদের মধ্যে নারী হিসাবে যেসব দুর্বলতা লক্ষ করা যায়, তা সহ্য করে নিতে অভ্যস্ত হওয়া স্বামীর একান্তই কর্তব্য।

পুরুষ হিসাবে পুরুষের মধ্যে যেসব দুর্বলতা থাকে তা ধৈর্যধারণ করা স্ত্রীর দায়িত্বও কর্তব্য। তাই স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক দোষগুলোর তুলনায় তাদের গুণগুলো এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি অপেক্ষা ভালো দিকগুলোর প্রতিই নজর রাখা বাঞ্ছনীয়। হাদিসে এসেছে ‘কোনো ইমানদার পুরুষ যেন কোনো ইমানদার নারীকে ঘৃণা না করে।

কেননা তার মধ্যে একটি ব্যাপার যদি অপছন্দনীয় থাকে, তাহলে অপরাপর গুণাবলি নিশ্চয়ই পছন্দনীয় পাওয়া যাবে। (মুসলিম) আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে ভালোভাবে বসবাস ও জীবনযাপন কর। তোমরা যদি তাদের অপছন্দ কর, তাহলে অসম্ভব নয় যে আল্লাহ তাদের মধ্যে অনেক কিছুই ভালো ও কল্যাণ জমা করে রেখেছেন।’ (সূরা নিসা-১৯)।

ইসলাম যেভাবে স্বামীকে স্ত্রীদের অপছন্দনীয় ব্যাপারাদি ধৈর্য ধারণ করতে ও পরম সহিষ্ণুতা দেখাতে বলেছেন, অনুরূপভাবে স্ত্রীদেরও নির্দেশ দিয়েছে নিজ নিজ স্বামীকে যথাসাধ্য সন্তুষ্ট রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে এবং স্বামীকে অসন্তুষ্ট রেখে রাত যাপন না করতে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের মাথার এক বিগত ওপরেও যায় না। এক ব্যক্তি সে, যে লোকদের ইমামতি করে অথচ সেই লোকেরা তাকে পছন্দ করে না। দ্বিতীয় সেই স্ত্রীলোক যে স্বামীকে অসন্তুষ্ট অবস্থায় রেখে রাত যাপন করে। আর তৃতীয় এমন দুই ভাই যারা পরস্পরের সঙ্গে লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত। (ইবনে মাজাহ)।

স্বামীর অবাধ্য হওয়ার অধিকার স্ত্রীর থাকতে পারে না। এরূপ যদি করা হয়ই, তাহলে পারস্পরিক সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে যাওয়া অবধারিত ও গুনাহের কাজ। সংসার তরী হাবুডুবু খাবে এবং কোনো প্রকৃত মাঝির অনুপস্থিতির কারণে তা সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়াও সম্ভব।

স্বামী যখন লক্ষ করবে যে, স্ত্রী তাকে অমান্য করছে, স্ত্রী তার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে চলছে, তখন তাকে ভালো উপদেশ দেবে, যুক্তিপূর্ণ প্রাণস্পর্শী কথাবার্তা দ্বারা তাকে সংশোধন করার সাধ্যমতো চেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু উপদেশ কার্যকর না হলে তার শয্যা আলাদা করে দিতে হবে, যাতে তার মধ্যে নারীসুলভ ভাবধারা জাগ্রত হয় এবং শেষ পর্যন্ত সঠিক বিষয়টি বুঝে স্বামীর আনুগত্য করে।

তা ছাড়া স্ত্রীদের মারধর করাটা রাসূল (সা.) আদৌ পছন্দ করেননি, তিনি বলেন, ‘তোমাদের এক একজন স্ত্রীকে এমনভাবে মারধর কর কেন, যেমন মনিব তার গোলামকে মারছে? আর তারপরই সম্ভবত রাত্রিকালেই সে তার সঙ্গে মেলামেশা করবে।’ যারা স্ত্রীদের মারধর করে তাদের হুঁশিয়ার করে রাসূল (সা.) বলেন, এ ধরনের লোক তোমাদের মধ্যে কখনো ভালো লোক বলে গণ্য হতে পারে না’।

ইসলামি শরিয়ত স্ত্রীদের শাসন করা জায়েজ করেছে কেবল স্ত্রীকে শরিয়তসম্মত ব্যাপারে বাধ্য করার জন্য। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলে করিম (সা.) তার কোনো বেগমকে কিংবা কোনো খাদেমকে কখনোই মারেননি। অপর কাউকেও তিনি কখনো মারধরের জন্য হাত তোলেননি। তবে আল্লাহর পথে কিংবা আল্লাহর মর্যাদার হানিকরণের দরুন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাউকে শাস্তি দিয়ে থাকলে তা স্বতন্ত্র ব্যাপার। (নাসায়ি)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *