মৌলভীবাজার-২ আসনটি গঠিত শুধু কুলাউড়া উপজেলা নিয়ে। ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ আসনে বরাবরই জাতীয় পার্টি শক্তিশালী। আওয়ামী লীগসহ সব দলের প্রার্থীদের দল বদল কিংবা দল ছেড়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার রেকর্ডও আছে এখানে। বর্তমান এমপি সুলতান মনসুরও আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপি জোট থেকে নির্বাচিত হন গতবার। প্রার্থীদের এমন ডিগবাজিতে ভোটারদের পাশাপাশি অতিষ্ঠ দলও। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে এই আসনে তাই নতুন মুখ খুঁজছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আওয়ামী লীগের পুরোনো পরীক্ষিত নেতা। কিন্তু গতবার তিনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হন। এতে তিনি দলীয় আস্থা হারিয়েছেন। পাশাপাশি ভোটারদেরও।
এদিকে, নির্বাচনী এলাকা ঘুরে ব্যানার-ফেস্টুনে নতুন প্রার্থীদের প্রচারণা চোখে পড়ার মতো। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, এবার মাঠে সক্রিয় নতুন প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগের পক্ষে এলাকায় কাজ করছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও প্রয়াত এমপি আব্দুল জব্বারের ছেলে আবু জাফর রাজু। তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসারের দায়িত্বে আছেন। এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন। স্কুল-কলেজ-মাদরাসার ভবন নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করছেন এলাকায়। এলাকায় ব্যানার, ফেস্টুন, তোরণেও তার সরব উপস্থিতি।
আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের বিষয়ে আবু জাফর রাজু সিলেট লাইনকে বলেন, মনোনয়নের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী জানেন। উনি কাকে মনোনয়ন দেবেন বা আমাকে দেবেন কি না, প্রধানমন্ত্রী ঠিক করবেন। আমি যেখানে যে পরিসরে থাকি, এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যাবো। প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন অথবা দল যদি মনে করে, তাহলে ঠিক আছে। যেহেতু আমার বাবা সেখানে এমপি ছিলেন। আমিও এলাকায় কাজ করছি।
এছাড়াও মাঠে আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। তারও কিছু ব্যানার-ফেস্টুন চোখে পড়েছে। তবে তিনি এলাকায় কম যান। বিভিন্ন উৎসব পার্বনে এলাকায় যান।
মনোনয়ন নিয়ে শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, ‘আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দলের মনোনয়ন চাইবো। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেন, আমি নির্বাচন করবো।’
এই আসনে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য, স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) সাদরুল আহমেদ খান বলেন, ‘আমি মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) থেকে মনোনয়ন চাই। আমার বাবা এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমার বড় ভাইও এখন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। আমি নিজেও ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে ডেপুটি সার্জন হিসেবে কাজ করেছি। এরপর থেকে আমার অভিভাবকরা এলাকায় কাজ করতে বলছেন, আমি সেটা করছি। এমনভাবে কাজ করছি, যাতে ৫৭৭টি গ্রামে কিছু না কিছু অবদান রাখতে পারি। এজন্য হেলথক্যাম্প, বন্যায় ত্রাণ বিতরণ, বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করছি।’
‘ম্যাপ ধরে এগোচ্ছি, সবগুলো গ্রামে কিছু না কিছু করবো। ইতিবাচক একটা প্রভাব যাতে থাকে। যাতে গ্রামের মানুষ মনে রাখে যে, এই লোক আসছিল। এভাবে এগোচ্ছি। আমার আব্বা এত বেশি সুনাম রেখে গেছেন, যেখানে যাই বেগ পেতে হয় না।’
নির্বাচনের মাঠে থাকবেন বর্তমান এমপি সুলতান মনসুরও। এবার মনোনয়ন চাইবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন আসুক, তখন দেখা যাবে। আমি রাজনীতি করি, রাজনৈতিক কর্মী, ৫৪ বছর এই রাজনীতিতেই কেটেছে। যতদিন শরীর সুস্থ থাকে, গণমানুষের সঙ্গে থাকবো।
ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে এমপি হলেও আওয়ামী ভাবধারায়ই চলছেন সুলতান মনসুর। এরই মধ্যে বিএনপি জোটের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। সংসদে বক্তৃতায় এমনটিই জানান দিয়েছেন।
এদিকে, রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, জোটের হিসাব-নিকাশে সুলতান মনসুর মাইনাস হলে কুলাউড়ায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নতুন মুখ আসছে নিশ্চিত। এছাড়া দলটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলকে সিলেট-১ আসনেও মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। তিনি সেখানেই থাকেন। যদি তাই হয়, কুলাউড়ায় আবু জাফর রাজু ও সদরুল আহমেদ খানই থাকছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এ দুজনেই আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নতুন মুখ।
কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেণু বলেন, আগামী নির্বাচনে আমি নিজেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আমার তো শেষ সময়। আমার রাজনীতির ৫০ বছর। আমাকে দিলে আমি পাস করে আসতে পারবো। আরও অনেকে প্রার্থী আছেন, কাজকাম করছেন। ঐক্যজোট হলে কাকে দেবে তা তো জানি না, জাতীয় পার্টিকেও দিতে পারে।
কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম বলেন, জাতীয় নির্বাচনে এবার এখান থেকে আমার বড় ভাই নির্বাচন করবেন।
তিনি বলেন, যেহেতু আমার বাবা এখানে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং নৌকার এমপি ছিলেন। সে কারণে আমরা আশা করছি- এবার যদি প্রধানমন্ত্রী আমাদের পরিবারকে দেন, তাহলে আওয়ামী লীগের মূল জায়গায় নৌকাটা ফিরে আসবে। আমার বড় ভাইকে দিক।প্রার্থিতার বিষয়ে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিয়াজুল ইসলাম তায়েফ বলেন, আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম শফি আহমেদ সালমান সাহেবও মনোনয়ন চাইবেন বোধহয়। শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ভাইয়ের অবস্থাও ভালো। উনি নেতাকর্মীদের নিয়ে এলাকায় কাজ করছেন। আমরাও আশাবাদী উনি পেলে পাস করবেন।
কুলাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত মৌলভীবাজার-২ জাতীয় সংসদের ২৩৬ নম্বর আসন। এখানে মোট ভোটার ২ লাখ ৪১ হাজার ১৬১। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ২২ হাজার ৪২২ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৩৯।
ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৮) বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর পান ৭৯ হাজার ৭৪২ ভোট এবং নৌকা প্রতীকে বিকল্প ধারার এম এম শাহীন পান ৭৭ হাজার ১৭০ ভোট।
১০ম সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মতিন আনারস প্রতীকে পান ৩০ হাজার ৮৭১ ভোট। জাতীয় পার্টির মহিবুল কাদির চৌধুরী লাঙল নিয়ে পান ২৫ হাজার ২৪১ ভোট।
৯ম সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) জাতীয় পার্টির নওয়াব আলী আব্বাস খান ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৪১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এম শাহীন ফুটবল প্রতীকে পান ৬৪ হাজার ৯৪২ ভোট।
৮ম সংসদ নির্বাচনে (২০০১) স্বতন্ত্র থেকে এম এম শাহীন ফুটবল প্রতীকে ৭৮ হাজার ৬৬৭ ভোট এবং আওয়ামী লীগের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মদ নৌকা প্রতীকে পান ৭১ হাজার ৮০৩ ভোট।
৭ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মদ নৌকা প্রতীকে ৫২ হাজার ৫৮২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টির নওয়াব আলী আব্বাস খান লাঙল প্রতীকে পান ৩৯ হাজার ৯৯২ ভোট।
৫ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) জাতীয় পার্টির নওয়াব আলী আব্বাস খান লাঙল প্রতীকে ৬১ হাজার ১০৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মদ নৌকা প্রতীকে পান ৪৫ হাজার ৫২৬ ভোট।
শেয়ার করুন