ব্রাজিলের জার্সিতেই খচিত আছে তাদের দুঃখের কাহিনী। ব্রাজিলের বর্তমান জার্সির রং হলুদ হলেও এককালে তাদের জার্সির রং ছিলো সাদা আর নীলের মিশ্রণ। অনেকটা আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের মতো। কেন সেই এই সাদা টি-শার্ট আর নীল শর্টস ফেলে দিয়ে তারা বেছে নিয়েছিল আজকের হলুদ সবুজ জার্সি। এ নিয়ে রয়েছে এক করুণ ইতিহাস।
জার্সি বদলের সেই ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে একজন সাংবাদিক ও লেখকের। যার তার নাম আলদির গর্সিয়া স্লে’ নামের একজন সাংবাদিক।
বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। আর প্রতি চার বছর পর সেই খেলা নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের মধ্যে দিয়ে ফুটবল হয়ে উঠে সারা বিশ্বের দর্শকদের জন্যে এক চরম বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু। একটি মাস তারা মেতে থাকেন ফুটবল আনন্দ উন্মাদনায়। বিশ্বকাপে খেলা যে কোনো দেশের জন্যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং সম্মানের। সে হিসেবে দেশটির খেলোয়াড়ের পরনের জার্সিও অনেক গুরুত্ব বা ইতিহাস বহন করে।
জার্সিতে কোনো দেশ তাদের পতাকার রঙ ব্যবহার করে, আবার কোনো দেশ জার্সিতে এমন রঙ বেছে নেয় যেটা তাদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি এমনকি ভৌগোলিক তাৎপর্য বহন করে। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে কিন্তু ফুটবল খেলায় কোন জার্সি বা নাম্বর বলে কিছু ছিল না।
ফুটবলে জার্সি ব্যবহার শুরু হয় ১৯১১ সালের দিকে। সেই জার্সিতে নাম্বার যোগ হয় আরো কয়েক বছর পর।জার্সির নাম্বার গুলো আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নাম্বার দেখে বলে দেওয়া যায় কোন খেলোয়াড় কোন পজিশনে খেলেন।
ফুটবলে ১ নাম্বার জার্সি গোলকিপারের জন্য, ২ থেকে ৬ নাম্বার জার্সি রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের জন্য এবং ৭ থেকে ১১ নাম্বার পর্যন্ত মধ্যমাঠ ও আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা ব্যবহার করেন। প্রথম দিকে ১ থেকে ১১ নাম্বার জার্সি পরিহিতরা মূল একাদশ হয়ে ম্যাচ শুরু করার একটা নিয়ম প্রচলন ছিলো, পরে ১৯৯৩ সাল থেকে ১ থেকে ১১ নাম্বার জার্সিতে ম্যাচের মূল একাদশ সাজানোর বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়।
অনেক দেশের জার্সি রঙের সঙ্গে মিশে রয়েছে মজার যেমন কাহিনী, তেমনি অনেক দেশের রয়েছে করুন ট্রাজেডি। জার্সি নিয়ে করুন এক কাহিনী রয়েছে আজকের নান্দনিক ফুটবল খেলার রূপকার ব্রাজিলের।
বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিল দলের অধিনায়ক কার্লোসের বলেন, ‘ব্রাজিলিয়ানদের কাছে হলুদ জার্সি হলো পবিত্রতার বার্তা। যখন আমরা এটি গায়ে দিই, তখন অবশ্যই গর্ব অনুভব করি। তবে একই সঙ্গে তা দায়িত্ববোধও নিয়ে আসে। এটা সবাইকে অনুপ্রাণিত করে এবং রোমাঞ্চে ভাসিয়ে দেয়।’
যাইহোক, বর্তমান ব্রাজিলের এই হলুদ জার্সিটা তাদের জাতীয় দলের আদি জার্সি নয়। মূলত ১৯৫০-এ ফাইনাল খেলায় উরুগুয়ের কাছে হারের পর থেকে তাদের এই হলুদ সবুজ সাদা ও নীল রং এর মিশ্রনে তৈরিকৃত ‘পবিত্র’ জার্সির জন্ম হয়।
সেবার স্বাগতিক ব্রাজিল ফাইনালে মুখোমুখি হয় উরুগুয়ের সঙ্গে। ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়ামে প্রায় দুই লাখ ব্রাজিল দর্শক তখন উদগ্রীব ছিলেন বিশ্বকাপ জয়ের ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে। উরগুয়ের বিপক্ষে সেই ম্যাচে জয় নয়, ন্যূনতম ড্র হলেই ব্রাজিল বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে পারতো। কিন্তু খেলা শেষ হবার ১১ মিনিট আগে উরুগুয়ের ঘিঘিয়ার গোলে ব্রাজিলিয়ানদের সে স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
মারকানার স্টেডিয়াম ভেসে যায় ব্রাজিলিয়ান দর্শকদের কান্না চোখের জলে। তাদের সেই কান্নায় উরুগুয়ের খেলোয়াড়দেরও হৃদয় ছুঁয়ে যায়। জয়োল্লাসের পরিবর্তে তখন তাদেরও কারো কারো চোখের কোনে জমেছিল জল।
সেই হারের স্মৃতি, সেই দল, এমনকি সেই সাদা জার্সি, নীল শর্টস আর সাদা মোজা; সব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্রাজিলিয়ানরা। ব্রাজিলের সেই সাদা জার্সিতে ছিল না দেশের কোনো ছাপ।
বর্তমানে পতাকার সবুজ রঙে যে বিশাল বনভূমি, সোনালি হলুদ রঙ এ যে খনিজ সম্পদের চিহ্ন, নীল ও সাদা রঙ এর তারায় যে রিও ডি জেনেরিওর সুবিশাল আকাশকে বোঝানো হয় তার কিছুই ছিল না ব্রাজিলের সে সময়কার সাদা জার্সিতে।
‘মারাকানাজ্জো’ খেলার ট্রাজেডিতে তারা ধরে নিলেন জার্সিতে এসব না থাকায় তাদের এমন পরাজয়। জার্সিটা বোধহয় ‘অপয়া’!
তাই ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশন (বিএফসি) সিদ্ধান্ত নিলেন এ সাদা নীল জার্সি তারা আর রাখবেন না। ১৯৫৩ সালে পত্রিকায় জার্সি পরিবর্তনের সংবাদ বেরোলো পত্রিকায়। ডিজাইনারদের কাছ থেকে ব্রাজিলের জার্সির ডিজাইন নেওয়ার প্রস্তাবও ছিলো সে সংবাদে। শর্ত ছিল ডিজাইনে থাকতে হবে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য পতাকার ছাপ। আর এ ডিজাইনগুলোর মধ্যে নির্বাচিত সেরা ডিজাইন নিয়ে তৈরি জার্সি পরেই ১৯৫৪ বিশ্বকাপের মাঠে নামবে ব্রাজিল দল।
চারশোর অধিক ডিজাইন জমা পড়ে। সাংবাদিক আলদির গার্সিয়া স্লে তখন ব্রাজিলের একজন তরুণ সংবাদকর্মী। বয়স সতেরো কি আঠারো। পত্রিকায় রিপোর্টসহ বিভিন্ন ছবি আঁকাজুঁকার চাকরি করেন। তিনি সংবাদ দেখে হলুদ সবুজের জার্সির কয়েকটি ডিজাইন বানিয়ে জমা দেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশনে।
সবার চোখ পড়ে আলদির গার্সিয়া স্লে’র হলুদ রঙের ডিজাইন। সেখান থেকে বাছাই করা হয় বর্তমানের এ জার্সিটি।
ঐতিহ্যবাহী এ জার্সির গৌরব যেমন ব্রাজিলের খেলোয়াড় থেকে ভক্ত- সবার কাছে তেমনি সেটা গৌরবের সাংবাদিক স্লে’র কাছেও কারণ তিনিই এই জার্সির রূপকার। শ্লে’র সেই হলুদ জার্সিতেই ১৯৫৪ সালে বিশ্বকাপ খেলতে সুইজারল্যান্ডের যায় ব্রাজিল। প্রথম ম্যাচেই জয় দিয়েই শুরু হয় হলুদ জার্সির পথচলা। তবে সেবার হাঙ্গেরির কাছে হেরে ব্রাজিলের অভিযাত্রা থেমে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে।
চার বছর পর আবার ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপ খেলতে সুইডেন যাত্রা। পেলের মিতো তারকা সব খেলোয়াড় নিয়ে এবার হলুদ সবুজ জার্সিতে ফাইনালে উঠল তারা। কিন্তু ফাইনালে স্লে’র সেই হলুদ জার্সি গায়ে চাপাতে পারেননি পেলের দল, কারণ সুইডেনের গায়ের জার্সিও হলুদ! ব্রাজিল তাই হলুদ জার্সি পরে মাঠে নামতে পারবে না।
এদিকে ব্রাজিল খেলোয়াড়রা কেউই তাদের সেই পুরোতন সাদা নীল জার্সি গায়ে দিয়ে খেলতে রাজি নয়। এক পর্যায়ে স্টকহোমের এক দোকানে গিয়ে কিনে আনা হলো ২২টি নীল জার্সি।
আর তাতে বসিয়ে দেওয়া হলো ব্রাজিল দলের লোগো। সেই জার্সিতেই বিশ্বজয় হলো!
’৬২ বিশ্বকাপের ফাইনালটা হলুদ জার্সি পরে জিতেছে ব্রাজিল। তবে সাদাকালোর ক্যামেরা যুগে একমাত্র গ্যালারির দর্শক ছাড়া বিশ্বের আর কেউ বুঝতে পারেনি অসাধারণ সেই দলটার গায়ে ছিল হলুদ জার্সি।
১৯৭০ সালে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় প্রথম রঙিন বিশ্বকাপ। এবার প্রথম টিভি পর্দায় দেখা গেল হলুদ সবুজ জার্সিতে দুরন্ত ব্রাজিলকে। ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে প্রথমার্ধে ১-১ গোলে সমতায় থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিল তার চিরাচরিত ছন্দ ও দ্রুততায় খেলে শেষ পর্যন্ত ৪-১ গোলে জিতে বিশ্বকাপ ।
শেয়ার করুন