বৃটেনে অভিবাসন ঠেকাতে কঠোর এক নীতিমালার প্রস্তাব করেছে দেশটির সরকার। সেই নীতিমালা কার্যকর হলে কেয়ার ভিসায় ডিপেন্ডেন্ট নেয়া যাবে না। স্পাউস ভিসার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে মানতে হবে একগাদা শর্ত। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, স্পাউস ভিসায় ডিপেন্ডেন্ট নেয়া যাবে, সে ক্ষেত্রে ন্যূনতম বেতন দেখাতে হবে ৩৮,৭০০ পাউন্ড। স্কিল্ড ওয়ার্কারের জন্যও নতুন আয়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রত্যেকের বাৎসরিক বেতন হতে হবে ৩৮ হাজার পাউন্ডের বেশি। অভিবাসন রোধে বৃটেনের ভিসা নীতি আরও কঠোর করার পরিকল্পনা বা প্রস্তাবনা সোমবার প্রকাশ করেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি। যদিও এ নিয়ে দেশটিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। ২০২২ সালে নেট মাইগ্রেশন রেকর্ড স্তরে পৌঁছানোর পর তা রোধে বৃটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাঁচদফা প্রস্তাবনা প্রকাশ করেন। বলা হয়, নেট মাইগ্রেশন হ্রাস করতে এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে বৃটিশ সরকার।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে বৃটেন ৭ লাখ ৪৫ হাজার অভিবাসী গ্রহণ করেছে, যা দেশটির অভিবাসন ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
বিবিসির রিপোর্ট মতে, রেকর্ড অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট উদ্বেগ থেকে কঠোর ওই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বৃটিশ সরকার। এতে যেসব পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে অভিবাসী দক্ষ কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি। আগে যেখানে তাদের ন্যূনতম বেতন ছিল ২৬ হাজার ২০০ পাউন্ড, এখন সেটি বাড়িয়ে ৩৮ হাজার ৭০০ পাউন্ড নির্ধারণ করা হয়েছে।
আর এই বেতন বৃদ্ধির ফলে গত বছর যে তিন লাখ নতুন অভিবাসী বৃটেনে আসার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিলেন, তারা বৃটেনে ঢুকতে পারবেন না বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লেভারলি। এ ছাড়া নতুন এই পরিকল্পনায় পারিবারিক ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম আয়ের পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। ফলে এখন থেকে পারিবারিক ভিসায় বৃটেনে যেতে হলে আবেদনকারীর ন্যূনতম আয় থাকতে হবে ৩৮ হাজার ৭০০ পাউন্ড। বৃটিশ পার্লামেন্ট মেম্বারদের উদ্দেশ্যে দেয়া এক বক্তব্যে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেন, বৃটেনে অভিবাসনের লাগাম টানা প্রয়োজন। বছরের পর বছর ধরে দেশটিতে স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা ভিসার অপব্যবহার করা হচ্ছে। মিস্টার ক্লেভারলির ভাষ্য ছিল এমন, ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। আমাদের অভিবাসন নীতি এখন থেকে অবশ্যই স্বচ্ছ, ন্যায্য ও টেকসই হতে হবে।’ বিবিসি বলছে, গত মাসে ২০২২ সালের অভিবাসন রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে। আর এতেই দেশটিতে অভিবাসন কমিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও তার সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সংসদ সদস্যরা। দেশটিতে অভিবাসীদের সংখ্যায় এমন বৃদ্ধি মিস্টার সুনাক ও ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টির জন্য একটি বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। কারণ ২০১০ সাল থেকেই অভিবাসন কমানোর ব্যাপারে তারা ধারাবাহিকভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। যদিও ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যমাত্রা ছিল না তাদের। স্মরণ করা যায়, পূর্বে বিদেশি দক্ষ শ্রমিক আসতে বাৎসরিক আয় ন্যূনতম ছিল ২৬,০০০ পাউন্ড, ফ্যামেলি ভিসার ক্ষেত্রে স্পাউস আনতে ১৮,৬০০ পাউন্ড, এখন উভয় ক্ষেত্রেই ৩৮,৭০০ পাউন্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৪ সাল থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হবে জনিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেন, ২০২২ সালে বৃটেনে চলে আসা আনুমানিক ১.২ মিলিয়ন লোকের মধ্যে ৩ লাখেরও বেশি লোক এটি করতে সক্ষম হবে না। এটি রেকর্ড নেট মাইগ্রেশন গতিকে কমাতে সাহায্য করবে।
নতুন নীতিমালায় যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো: বিদেশি দক্ষ শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ২৬,২০০ পাউন্ড থেকে বাড়িয়ে ৩৮,৭০০ পাউন্ড করা। ফ্যামেলি ভিসার ক্ষেত্রে স্পাউস আনতে ১৮,৬০০ পাউন্ড থেকে বাড়িয়ে ৩৮,৭০০ পাউন্ডে উন্নিত করা। তাছাড়া কেয়ার কর্মীরা ডিপেন্ডেন্ট নিতে না পারা এবং কেয়ার ভিসা স্পন্সরকারী প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে কেয়ার কোয়ালিটি কমিশনে নিবন্ধন গ্রহণ। তাছাড়া শর্টেজ অকুপেশন লিস্টেরও সংস্কার, স্টুডেন্ট ভিসায় ডিপেন্ডেন্ট নেয়ার নিয়মকে আরও কঠিন করা, মাইগ্রেশন অ্যাডভাইজরি কমিটি কর্তৃক স্নাতক ভিসা রুটের সম্পূর্ণ পর্যালোচনা ইত্যাদি। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে অভিবাসন নীতির বিষয়টি বৃটেনে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে জানিয়ে বিবিসি বলছে, এ অবস্থায় জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে দেশটিতে অভিবাসনের সংখ্যা কমানোর জন্য ‘যা করা প্রয়োজন তা করার’ নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। নতুন পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য ও পরিচর্যাকর্মীদের পরিবারকে বৃটেনে নিয়ে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এ ছাড়া যেসব কোম্পানি তাদের বর্তমান বেতন কাঠামোর চেয়ে ২০ শতাংশ কম বেতন দিচ্ছে, তারা যেন অভিবাসী শ্রমিকদের নিতে না পারে, সে ব্যাপারেও কঠোর হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে যারা বৃটেনে পড়তে যান, সেই সব শিক্ষার্থীরা যেন ইচ্ছা করলেই তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশটিতে নিতে না পারেন, সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এসব পরিবর্তন আগামী বসন্ত থেকে কার্যকর করার চিন্তা রয়েছে জানিয়ে বৃটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্লামেন্ট মেম্বারদের বলেন, এই নীতির ফলে গত বছরের তুলনায় আগামী বছর অন্তত তিন লাখ কম অভিবাসী বৃটেনের ঢুকবে। নতুন নীতির কারণে বৃটেনে পড়তে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীরাও এখন চাইলে আর তাদের পরিবারের সদস্যদের নিতে পারবেন না। আর এতেই অভিবাসীদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে বলে বিশ্বাস করেন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এদিকে, নতুন এই পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়ায় লেবার পার্টির সংসদ সদস্য ইভেট কুপার বলেন, সোমবারের ঘোষণা এটি বুঝিয়ে দিয়েছে যে, অভিবাসন ব্যবস্থা ও অর্থনীতি- উভয় ক্ষেত্রেই বছরের পর বছর ধরে টোরিরা কীভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
তিনি বলেন, অভিবাসীদের সংখ্যায় লাগাম টানা উচিত, অথচ এ বিষয়ে কনজারভেটিভরা আর উল্লেখযোগ্য কোনো টেকসই সংস্কার আনতে পারছে না। অন্যদিকে, বৃটেনের ট্রেড ইউনিয়ন ইউনিসনের জেনারেল সেক্রেটারি ক্রিস্টিনা ম্যাকানিয়া নতুন অভিবাসন নীতিকে নিষ্ঠুর বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই পরিকল্পনা বৃটেনের স্বাস্থ্য ও সামাজিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ক্রিস্টিনা বলেন, অভিবাসী শ্রমিকদের বৃটেনে প্রবেশে উৎসাহিত করা হয়েছিল, কারণ উভয় সেক্টরেই কর্মীদের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। হাসপাতাল ও কেয়ার হোমগুলো এসব অভিবাসী শ্রমিকদের ছাড়া কাজ চালাতে পারবে না। তবে নতুন এই পরিকল্পনাকে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির অনেক সংসদ সদস্য স্বাগত জানিয়েছেন।
সাবেক মন্ত্রী সাইমন ক্লার্ক একে ‘বাস্তবসম্মত’ ও ‘বিশ্বাসযোগ্য’ পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। যদিও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান মিস্টার ক্লেভারলির নতুন পরিকল্পনায় খুব একটা খুশি নন বলে জানান। তারমতে, নতুন এই পরিকল্পনাটি খুব দেরিতে হয়েছে এবং এটাতে আরও অনেক কাজ করা উচিৎ ছিল, যেটা করা হয়নি। বিশেষত অভিবাসী কর্মীদের বেতন এবং অভিবাসী শিক্ষার্থীদের লাগাম টানার ক্ষেত্রে অনেক কাজ করার ছিল বলে মনে করেন সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
শেয়ার করুন