গত ১৫ বছর ধরে জামায়াতে ইসলামীর কোনো ধরনের কার্যক্রম নেই বলে ধারণা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী এই দলটি গোপনে পুনরায় সংগঠিত হয়েছে বলে গোয়েন্দা তথ্য ও দলটির নথি থেকে জানা গেছে।
২০০৮ সালে দলটির স্থায়ী সদস্য বা রুকনের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৮৬৩। পুলিশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বর্তমানে দলটির স্থায়ী সদস্য সংখ্যা ৩ গুণ বেড়ে ৭৩ হাজার ৪৬ জনে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একই সময়ে এই দলটির কর্মী সংখ্যা আগের ২ লাখ ২১ হাজার থেকে ৩ গুণ বেড়ে ৬ লাখ ৩৯ হাজার হয়েছে। খবর দ্য ডেইলি স্টারের
পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গত শনিবার রাজধানী ঢাকায় সমাবেশ করায় আবারও আলোচনায় এসেছে জামায়াতে ইসলামী। গত ১ দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো দলটিকে এমন অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পরদিন রোববার সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে মন্তব্যও করেন ৪ মন্ত্রী।
অনুমতি বিষয়ে রোববার কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, জামায়াতের জনসমর্থন রয়েছে এবং তারই আলোকে সরকার দলটিকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে।
পুলিশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও তহবিল নিয়ে জামায়াতের কৌশলের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।
দলের গোপন নথি, শীর্ষ নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও দলের নেতাদের মধ্যকার যোগাযোগের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
দলটির কিছু নথির পাশাপাশি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের একটি অনুলিপিও প্রতিবেদকের কাছে আছে।
দলটির নথির তথ্য অনুযায়ী, তাদের নারী রুকনের সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বেড়েছে এবং নারী কর্মী বেড়েছে ৪ গুণ। একইভাবে ২০০৮ সালে দলের সহযোগী সদস্য ১ কোটি ৩ লাখ থাকলেও এখন তা বেড়ে ২ কোটি ২৯ লাখে দাঁড়িয়েছে।
দলের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে জামায়াতের নায়েবে আমির (উপপ্রধান) আবদুল্লাহ মো. তাহের জানান, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি।
‘তবে আমরা গোপনে আমাদের “দাওয়াতি” কার্যক্রম চালিয়ে গেছি এবং তা চালিয়ে যাব’, যোগ করেন তিনি।
দলের সদস্য, বিশেষ করে নারী সদস্য বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি জানান, এটা তাদের দাওয়াতি কার্যক্রমের ফল। তারপরও নারীদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তবে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে নারীর সংখ্যা বেশি।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় জামায়াত। ২০১৩-২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংস সরকারবিরোধী আন্দোলনে দলটির অনেক নেতা গ্রেপ্তার হন।
দলটির বেশিরভাগ শীর্ষস্থানীয় নেতা যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হন তখন দলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির ৫ শীর্ষ নেতার মৃত্যৃদণ্ড এবং সাজাপ্রাপ্ত আরও ৩ নেতা কারাগারে মারা যান। একইসঙ্গে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আরও ২ শীর্ষ নেতা সাজা ভোগ করছেন।
জামায়াতে ইসলামীর তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত দলটির প্রায় ১ হাজার ৮৫০ জন নেতা কারাগারে আছেন, যেখানে ১৫ জন জামায়াত নেতা গুমের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। দলটির দাবি, গত ১২ বছরে তাদের ২৯৪ জন কর্মী নিহত হয়েছেন।
১৯৪১ সালে আবুল আলা মওদুদী প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীকে তাদের সাম্প্রদায়িক ভূমিকার জন্য পাকিস্তানে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সাল মিলিয়ে ২ বার নিষিদ্ধ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দলটি সরাসরি দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও স্বাধীনতাকামীদের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়।
১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়ক আল-বদর বাহিনী। বাহিনীটি মূলত মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয়।
জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ পর্যবেক্ষণ করেছে, ‘… ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে অভিযুক্ত গোলাম আযমের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ইচ্ছাকৃতভাবে একটি অপরাধমূলক সংগঠন হিসেবে কাজ করেছিল।’
স্বাধীনতার পর দলটিকে আবার নিষিদ্ধ করা হলেও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তাদের রাজনীতিতে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার জন্য দীর্ঘদিন ধরে ন্যায়বিচারপ্রত্যাশী, যুদ্ধাপরাধের শিকার ও তাদের পরিবারের সদস্যরা দল হিসেবে তাদের বিচার করার দাবি জানিয়ে আসছে।
জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকার জন্য দলটির কখনো অনুশোচনা হয়নি বা তারা ক্ষমা চায়নি। ২০১৭ সালে দলের মধ্যে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধে দলটির ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে এবং এর গঠনতন্ত্রে সংস্কার আনতে দলের ব্যর্থতার বিষয়টি উল্লেখ করে ২০১৯ সালে জামায়াতের তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক পদত্যাগ করেন।
বিএনপি ১৯৯৯ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করে এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ৪ দলীয় জোট গঠন করে। পরবর্তীতে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর জোট সরকার গঠন করে এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারে জামায়াতের সাবেক আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলকে মন্ত্রী করা হয়।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে জামায়াত তখন তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করে।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৩-২০১৫ সালে করা আন্দোলন ব্যর্থ এবং সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য দেশ-বিদেশে সমালোচনার সম্মুখীন হওয়ায় বিএনপি ও জামায়াত তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব কৌশলী হয়।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসে ২ দলের মধ্যকার এই দূরত্ব কমিয়ে তারা অনেকটাই কাছাকাছি এসেছে এবং সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাস্তবায়নের দাবিতে একযোগে আন্দোলন চালাতে সম্মত হয়েছে।
২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন হাইকোর্ট বেআইনি ঘোষণা করেন। এই রায়ের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালের অক্টোবরে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে।
গত অক্টোবরে ইসির কাছে নিবন্ধনের আবেদন করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামের একটি দল। জামায়াতের লোকজনই ছদ্মবেশে এই দল গঠন করতে চেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিডিপির শীর্ষ নেতারা জামায়াতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দলটির সাধারণ সম্পাদক জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা।
চলতি মাসের শুরুতে জামায়াতের কয়েকজন সাবেক নেতার প্রতিষ্ঠিত আমার বাংলাদেশ পার্টিও রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল।
বিডিপি ও আমার বাংলাদেশ—কাউকেই নিবন্ধন দেওয়া হয়নি।
পুলিশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এরপরও দলটি গত ১৫ বছরে পুনরায় সংগঠিত হয়েছে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দলটি দ্বৈত নীতি গ্রহণ করেছে।
ইতোমধ্যে তারা ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা এবং ১০টি মন্ত্রণালয়ের জন্য সম্ভাব্য মন্ত্রীদের প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা।
প্রার্থী বাছাইয়ের সময় জামায়াত বিভিন্ন পেশায় থাকা ব্যক্তিদের গুরুত্ব দিয়েছে, যেমন: ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পুলিশ ও সাবেক আমলা। যারা জনপ্রিয় ও নিজ এলাকায় যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে, তাদেরও তালিকায় রাখা হয়েছে।
দলটি ইতোমধ্যে সদস্যদের কাছ থেকে নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করাও শুরু করেছে। সারাদেশে সব ইউনিটকে চিঠি দিয়ে দলের সদস্যদের নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের জন্য অতিরিক্ত অর্থ দিতে বলেছে জামায়াতে ইসলামী।
যেসব নির্বাচনী এলাকায় শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে, সেখানে ভোটার বাড়াতে কৌশল গ্রহণ করেছে দলটি। শহরাঞ্চলেও তারা তাদের ভোটারদের সংঘবদ্ধ করেছে।
যেসব নির্বাচনী এলাকায় জামায়াতপন্থী ভোটারদের জয়ের সম্ভাবনা কম, তাদের পাঠানো হবে এমন জায়গায়, যেখানে সম্ভাবনা বেশি।
জামায়াত তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি প্রসারিত করতে এবং নতুন সদস্য ও তহবিল সংগ্রহের জন্য বিদেশেও কার্যক্রম বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
পুলিশের নথি অনুযায়ী, জামায়াত গত বছর বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও বিদেশের ইসলামিক সংগঠনকে চিঠি পাঠিয়েছে, যেখানে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্ণনা করা হয় এবং বর্তমান সরকারকে ‘ইসলামবিরোধী’ বলে উল্লেখ করা হয়।
দলটি গত ৮ ডিসেম্বর মুসলিম ব্রাদারহুডের চেয়ারম্যান, ২৪ নভেম্বর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী, ৬ নভেম্বর তুরস্কের ওয়েলফেয়ার পার্টির চেয়ারম্যান, ২৪ অক্টোবর তুরস্কের ফেলিসিটি পার্টির সভাপতি, ১৭ অক্টোবর তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও ৩০ সেপ্টেম্বর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে চিঠি দেয়।
নথি অনুযায়ী, দলটি বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং বর্তমানে তাদের নির্দিষ্ট কোনো কার্যালয় নেই। ভাড়া বাসায় তারা তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সারাদেশে ওয়াজ মাহফিলের মতো বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সমাবেশের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী তাদের সভা-সমাবেশ, মতাদর্শ প্রচার ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
শেয়ার করুন