গ্রেপ্তারের ভয়ে পুরুষশূন্য গ্রাম, নষ্ট হচ্ছে ৩৫ লাখ টাকার পাকা ধান

জাতীয়

হত্যা মামলায় আসামি হওয়ায় মাদারীপুরে একটি গ্রামের ২৫ পরিবারের প্রায় একশ বিঘা জমির ধান পেকে মাটিতেই ঝরে পড়ছে। ধান কাটতে দিচ্ছে না বাদীপক্ষের লোকজন। মাদারীপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের পূর্ব কলাগাছিয়া গ্রামের ঘটনা এটি।

পুরুষশূন্য এলাকায় নারীরাও জমিতে ধান কাটতে গেলে দেওয়া হচ্ছে বাঁধা। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছে, চলতি মৌসুমে ধান ঘরে তুলতে না পারলে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকার ক্ষতি হবে তাদের।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ মার্চ কলাগাছিয়া এলাকার স্থানীয় যুব সমাজের উদ্যোগে বনভোজনের আয়োজন করা হয়। এতে গাড়িতে সামনে বসা নিয়ে মিল্টন হালদার ও প্রকাশ বৈরাগীর মধ্যে ঝগড়া হয়। পরদিন সকালে হালদার ও বৈরাগী বংশের লোকজন সংঘর্ষে জড়ায়। এতে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাধাকান্ত হালদার ওরফে রাধিকাকে (৬০) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে চার দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি মারা যান।

এ ঘটনায় রাধাকান্তের স্ত্রী মিতালী হালদার বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় ৪০ জনের নাম উল্লেখসহ ৮-১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা করেন। পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আসামিপক্ষের লোকজনের ফসলি জমিতে ধান কাটাতে বাঁধার সৃষ্টি করছেন বাদীপক্ষের লোকজন।

মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে পূর্ব কলাগাছিয়ার ওই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আসামিপক্ষের প্রায় ৪০ জন কৃষকের ক্ষেত মিলিয়ে একশ বিঘা জমির বোরো ধান পুরোপুরি পেকে গেছে। ধান না কাটায় এরই মধ্যে ঝড়েছে ধানের দানা। খরতাপে দ্রুত এসব ধান না কাটলে জমিতেই নষ্ট হওয়ার উপক্রম।

স্থানীয় কয়েকজন নারী জমিতে ধান কাটতে গেলে তাঁদের বাধা দিচ্ছে কিছু লোক। এমনকি ভাড়া করা শ্রমিক দিয়েও ধান কাটতে গেলে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে। নিজেদের জমিতে ধান কাটতে না পারায় কান্নায় ভেঙে পড়েন কিষানি রাধিকা হালদার।

রাধিকা বলেন, ‘ধানে কী দোষ করিল? এই ধান বেইচাই তো আমাগো সংসার চলে। জলদি যদি ধান কাটবার না পারি, তাইলে আমাগো সারা বছর না খাইয়া থাকা লাগবে। ধান পাইক্কা সব মাটিতেই পইড়া যাচ্ছে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর স্থানীয় পর্যায়ে যেসব কৃষি উন্নয়ন সমিতি গঠন করেছে, তার অধীনে পূর্ব কলাগাছিয়া এলাকার ব্লক ম্যানেজার কামাল মাতুব্বর। তিনি জানান, পূর্ব কলাগাছিয়া এলাকায় মারামারিতে একজন লোক মারা গেছেন। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিপক্ষের লোকজন পলাতক। বাড়িতে শুধু নারী সদস্যরা রয়েছেন। এই আসামিপক্ষের জমিতে ধান পেকে গেছে, কিন্তু বাদীপক্ষের লোকজন ধান কাটতে দিচ্ছেন না। তিন থেকে চার দিনের মধ্যে সব ধান নষ্ট হয়ে যাবে। এতে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হবে কৃষক পরিবারগুলোর। এই গ্রামের জমিতে ধানের যে ধরনের ফলন এসেছে তাতে প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে ৩৫ মণ ধান উৎপাদন হবে।

ভুক্তভোগী এক কৃষক সুকুমার ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামী বলেন, ‘একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্বামীসহ পরিবার ও বংশের সব পুরুষ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। সবাই পলাতক। চাষ করা জমিতে ধান পেকে নষ্ট হচ্ছে, আমরা নারীরা জমিতে ধান কাটতে এলে লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের ওপর বাদীপক্ষ হামলা চালায়। এই ধান ঘরে তুলতে না পারলে সারা বছর না খেয়ে মরতে হবে।’

আরেক কৃষক প্রহ্লাদ মালের স্ত্রী বিনা রানী মাল বলেন, ‘আমার স্বামী, দেবর, ভাশুর সবাই বাড়িছাড়া। আমাদের পরিবারের লোকজন জমিতে চাষ করে গেছে, সেই জমিতে এখন ধান পেকে নষ্ট হচ্ছে। ধান কাটতে গেলে বাদীপক্ষ হামলা চালায়, পরে ভয়ে জমি থেকে উঠে চলে যাই।’

কৃষক দিলীপ বৈরাগীর স্ত্রী চম্পা বৈরাগী বলেন, ‘এই এলাকার জমি একফসলি। বছরে একবারই জমিতে ধান হয়। এই ফসল ঘরে তুলতে না পারলে ছেলে-মেয়ে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। এখন বেঁচে থাকার কোনো রাস্তা নেই, ধান কাটতে এলে বাদীপক্ষের লোকজন লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। আমাদের ধাওয়া দিয়ে জমি থেকে তাড়িয়ে দেয়। আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাই।’

জমিতে ধান কাটতে বাধা দেওয়ার কথা স্বীকার করছেন বাদীপক্ষের লোকজন। নিহত রাধাকান্ত হালদারের ভাইয়ের ছেলে বিপ্লব হালদার বলেন, ‘আসামিদের পরিবারের কটূক্তিমূলক কথার কারণেই ধান কাটতে বাঁধা দেওয়া হয়েছে। জমির ধান জমিতেই থাকবে। অন্য কেউ ধান কাটতে পারবে না।’

নিহত রাধাকান্তের পুত্রবধূ লক্ষ্মী রানী হালদার বলেন, ‌‘আসামিদের পরিবারের নারী সদস্যরা অনেক গালিগালাজ করেন, তাই ধান কাটতে দেওয়া হচ্ছে না। মামলার আসামি যাঁরা, তাঁরা সরাসরি ধান কেটে নিয়ে যাক, অন্য কেউ ধান কাটতে এলে এমনই হবে।’

মাদারীপুর জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা বাবুল হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে নতুন ধান এক হাজার টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। তাতে সর্বনিম্ন একশ মণ ধানের বাজার দর এক লাখ টাকা রয়েছে। এই হিসাবে সাড়ে তিন হাজার মণ ধানের বাজার মূল্য ৩৫ লাখ টাকা আছে।’

এ বিষয়ে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, ‘জমির পাকা ধান ঘরে তুলতে বাঁধা দেওয়াও আরেকটি অপরাধ। আমাদের কাছে ভুক্তভোগীরা যদি অভিযোগ করেন, তাহলে পুলিশের পক্ষ থেকে ধান কেটে নেওয়ার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *