ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে ৩৮ জনের প্রাণহানি

জাতীয়

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে গাছ ভেঙে পড়ে, দেয়াল ধসে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং পানিতে ডুবে দেশের বিভিন্ন জেলায় অন্তত ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে দেশের ১৭ জেলায় এসব মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

ভারি বর্ষণ আর জলোচ্ছ্বাস সঙ্গী করে সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। এর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই উপকূলের জেলাগুলোতে ঝড়ো হাওয়া আর ভারি বর্ষণ শুরু হয়।

ফুঁসে উঠে সাগর। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট বৃদ্ধি পায়। প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ায় সেন্টমার্টিনে নোঙর করে রাখা ১৫টি মাছ ধরার ট্রলারও ডুবে যায়। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বহু বাড়িঘর।

সোমবার সন্ধ্যা থেকেই উপকূলের বিভিন্ন জেলায় গাছ ভেঙে সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে অন্ধকারে ডুবে আছে অনেক জেলার লোকজন।

এদিকে, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের সন্দ¦ীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে ৮ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাতে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজারডুবির ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম নগরের মোহরায় জোয়ারের পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মোবারক হোসেন নামে এক যুবক ও সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডে ভেসে এসেছে ৩ মাসের এক শিশুর মরদেহ।

ভোলায় মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের । গাছের চাপায় প্রাণ যায় বিবি খাদিজা (৬৮) নামের এক নারীর। চরফ্যাশন উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় মোটরসাইকেলে করে ২ জন যাওয়ার পথে গাছের ডাল পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান স্বর্ণ ব্যবসায়ী মো. মাইনুদ্দিন (৪৫)। ভোলা সদর উপজেলার চেউয়াখালী গ্রামের মফিজুল ইসলাম (৭০) ঘরচাপায় এবং লালমোহন উপজেলার ফাতেমাবাদ গ্রামের ফরিদুল ইসলামের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (২৫) পানিতে ডুবে মারা যান।

টাঙ্গাইলের মধুপুরে ঝড়ের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় ২ পুলিশ কনস্টেবল নুরুল ইসলাম ও মো. সোহেল এবং আসামি লালন নিহত হন। ঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকে তলিয়ে যাওয়া আইপিএস সরাতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্টে মারা যান টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়া পাঞ্জাপাড়া এলাকার শরীফ ফকির।

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা হেসাখাল গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় সোমবার রাতে ঘরের ওপর গাছ পড়লে এক পরিবারের ৩ জন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- নিজাম উদ্দিন, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার ও তাদের ৪ বছরের মেয়ে নুসরাত আক্তার।

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে সোমবার রাতে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মারা যান মর্জিনা বেগম (৪০) নামের এক নারী।

বরগুনা সদর উপজেলার সোনাখালী এলাকায় একটি ঘরের চালে গাছ পড়লে ওই ঘরে থাকা আমেনা খাতুন নামের এক নারী মারা যান।

প্রবল ঢেউয়ে সিরাজগঞ্জে নৌকাডুবিতে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- উপজেলার পূর্বমোহনপুর গ্রামের খোকনের স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৮) এবং তার ছেলে আরাফাত হোসেন (২)।

গাছচাপায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পাঁচকাহনিয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) ও বাঁশবাড়ির চরপাড়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রোমেছা বেগম (৫৮) মারা যান।

ঝড়ের সময় রান্নাঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা গ্রামে আইনজীবী মো. আবদুল্গাহর ১১ বছর বয়সী শিশু সন্তান সানজিদ আফ্রিদি মারা গেছে।

শরীয়তপুরের জাজিরার সিডারচর এলাকায় গাছের নিচে চাপা পড়ে সাফিয়া বেগম (৬৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়।

কক্সবাজারের টেকনাফে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়লে ডেক থেকে পড়ে শৌমিং (৭১) নামের এক বাবুর্চির মৃত্যু হয়। তিনি মিয়ানমারে নাগরিক। এছাড়া ঝড়ের সময় নিখোঁজ সোহেনা (৯) নামে এক শিশুর লাশ টেকনাফ পৌরসভার একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়।

পটুয়াখালী সদর উপজেলার প্রতাপপুর খেয়াঘাট এলাকায় লোহালিয়া নদীতে ইটবোঝাই ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন ট্রলারের শ্রমিক নুরুল ইসলাম (৪৫)।

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ইকুরিয়া গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় ঘরচাপায় আনিসুর রহমান (৯) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়।

মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কনকসার এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী আসমা বেগম (২৮) ও তার মেয়ে সুরাইয়া আক্তার (৩) বসতঘরে গাছ ভেঙে পড়লে মারা যান।

এদিকে, কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তাৎক্ষণিক তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে ৫৮ হাজার ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের ভাষ্য, সিত্রাংয়ের যে ভয়ঙ্কর মূর্তি ছিল তা পূর্ণরূপ গ্রহণ না করায় ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কার চেয়ে কম হয়েছে।

তিনি জানান, ১০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৯ জন। ফসলি আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার হেক্টর। মৎস্য ঘের ভেসে গেছে এক হাজার। সরকার বলছে, তারা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছে।

পূর্বাভাসে ঘাটতি, আবহাওয়া অধিদপ্তরের ব্যাখ্যা : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং নিয়ে পূর্বাভাস ছিল গত ১ অক্টোবর। তারপরও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রস্তুতিতে ছিল ভাটা। পূর্বাভাস, সতর্কবার্তা পৌঁছানো ও আগাম প্রস্তুতিতে ফুটে ওঠে ঘাটতি। একেক সময় একেক বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশে সিত্রাং আঘাত হানার তথ্য নিয়েও শেষ মূহূর্তে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। যদিও সোমবার তিনি তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যেও ছিল গরমিল। বাংলাদেশের উপকূলে সিত্রাং আঘাত করার সময় নিয়ে আগের করা পূর্বাভাসগুলোও পুরোপুরি মেলেনি।

গতকাল মঙ্গলবার এর ব্যাখ্যাও দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তারা বলছে, শুরু থেকেই সিত্রাংয়ের আচরণ ছিল এলোমেলো। বারবার পাল্টাতে থাকে গতিপথও। তাই এর গতিবিধি ঠিকমতো বোঝা যায়নি। আসতে পথে বৃষ্টি ঝরিয়ে নিজের শক্তি ক্ষয় করেছে। এসেছে দ্রুত, চলেও গেছে দ্রুত।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় হিসেবে গঠিত হওয়ার আগে নিম্নচাপের সময়ই এটি তিন অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। আর বারবার পাল্টেছে গতিপথ। প্রথমে ভারতের ওড়িষা, পরে পশ্চিমবঙ্গ এবং শেষে বাংলাদেশের উপকূলমুখী হয়েছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরও সোমবার পর্যন্ত একে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বলেছে। কিন্তু আসার পথে এটি প্রবল বৃষ্টি ঝরায়। তাতে এর শক্তিক্ষয় হয়। তাই এটি দ্রুত আসে এবং দ্রুতই চলে যায়। রাত একটার মধ্যেই উপকূল মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায়। ৬ ঘণ্টার মধ্যে এটি শক্তিহীন হয়ে পড়ে।

বজলুর রশীদ আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের ব্যতিক্রমী আচরণের জন্য এটি নির্ণয়ের মডেলগুলোতেও পরিবর্তন হয়েছে বারবার। অনিশ্চিত গতিবিধির কারণেই এর আসার সময় এবং এর আকার সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *