চাকমা সমা‌জের ‌বিখ‌্যাত এক প্রেম উপখ‌্যানের নাম রাঙামাটি জেলার বরকলের চান্দবী ও নোয়ারাম

জাতীয়

আরিফুল ইসলাম সিকদার:

প্রায় দেড় শত বছর আ‌গে বরক‌লের সুবলং অঞ্চ‌লে চান্দবী না‌মে এক পরমা সুন্দরী নারীর জন্ম হয়। চান্দবী জন্ম হবার আগে চান্দবীর বাবা মা এক ব্রাক্ষণকে দি‌য়ে গ‌নি‌য়ে ছি‌লেন, তারাই মেয়ের নাম চান্দবী রাখার পরামর্শ দেন। চান্দবীর বাবা মা ঐ ব্রাক্ষণকে জি‌জ্ঞেস ক‌রেছি‌লেন আমাদের চান্দবী কোন জাত হবে? তখন ব্রাক্ষণ বলেছি‌লেন, আপনাদের মেয়ে চান্দবী পদ্ধিনী জাত হবে। পদ্ধিনী নারীরা অতি সুন্দর, সতী পতিব্রত সদাই ধর্ম পরায়ন হয়,কোকিলের মত মধুর স্বর, সদা হাস্যজ্জল আপনার মেয়ের এই লক্ষণ থাকবে।

চান্দবী জন্মাবার পর বয়স যখন এক বছর থেকে পাচঁ বছর হয়। তখন চান্দবীর বাবার হঠাৎ করে মৃত্যু হয়। তখন বাবার মৃত্যুতে মা মেয়ে শোকাহত হয়ে পড়ে। তারপর থে‌কে চান্দবীর মা’ই তা‌কে কো‌লে পি‌ঠে বড় ক‌রে তুলেন।

এ‌দি‌কে চান্দবী যতই বড় হ‌তে থা‌কে ততই তার রূ‌পের ছটা বাড়‌তে থা‌কে। চান্দবী এতই রূপবতী ছি‌লেন যে একবার তার দি‌কে তাকালে চোখ ফেরা‌নো যেত না। তার রূপে পাগল যুবকরা তা‌কে একনজর দেখার জন‌্য নানা অজুহা‌তে আ‌শেপা‌শের গ্রাম থে‌কে চান্দবী‌দের গ্রা‌মে ভিড় জমা‌তো।
তার গা‌য়ের রং ছিল দুধকলা মেশা‌নো রঙ, গাল দু‌টো ছিল পাকা ম‌রি‌চের মত লাল, চোখ ছিল হ‌রি‌ণের মত টানা, অমাবস‌্যার মত কালো চুল।

সেই আম‌লে রূপবতী চান্দবীর রূ‌পের কথা চা‌রি‌দি‌কে ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে‌ছিল। পা‌ণিপ্রার্থীরা সবাই পরমা সুন্দরী চান্দবী‌কে জীবন সঙ্গী‌নি করার স্বপ্ন দেখ‌তো। একসময় চান্দবীর রূপের কথা কু‌কিরাজার কানেও গি‌য়ে পৌছা‌লে ‌তি‌নিও চান্দবী‌কে বি‌য়ে করার জন‌্য প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু চান্দবী সেই প্রস্তাব ফি‌রি‌য়ে দি‌য়ে‌ছিল‌েন। ক‌থিত আ‌ছে তার রূপে মুগ্ধ হ‌য়ে সেই সময়কার চাকমা রাজাও চান্দবীর পা‌ণিপ্রার্থী হ‌য়ে‌ছি‌লেন। কিন্ত‌ু চান্দবী রাজার সেই প্রস্তাবও ফি‌রি‌য়ে দি‌য়ে‌ছি‌লেন। কারণ চান্দবী ম‌নেপ্রা‌ণে ভালবাস‌তেন একই গ্রা‌মের নোয়ারাম‌কে। সবার অ‌গোচ‌রে চল‌তো দুজ‌নের ম‌ধ্যে প্রেম। দি‌নের পর দিন, মা‌সের পর মাস। এক সময় চান্দবীর প‌রিবার চির‌দি‌নের জন‌্য সুবলং ত‌্যাগ ক‌রে থেগা অঞ্চ‌লে চ‌লে আ‌সে। এরপর হ‌তেই দুজ‌নের ম‌ধ্যে শুরু হয় বিরহ যাতনা। দুজন দুজ‌নের সা‌থে দেখা করার জন‌্য উতলা হ‌য়ে থাক‌তো। এক পর্যা‌য়ে নোয়ারাম কা‌ত্তো‌নের অজুহাত দে‌খি‌য়ে নি‌জে নৌকা চা‌লি‌য়ে সুদুর থেগায় চ‌লে আ‌সে চান্দবীর সা‌থে দেখা করার জন‌্য এবং চান্দবীর সা‌থে আবারও সাক্ষাৎ হ‌লে দুজ‌নের প্রেম ভালবাসা নতুন ক‌রে গ‌তি লাভ ক‌রে।

এভা‌বে নোয়ারামের সাথে ভালবাসার প‌রিনা‌মে এক পর্যা‌য়ে চান্দবী গর্ভবতী হ‌য়ে প‌ড়ে। দুঃখজনক যে প‌রে নোয়ারাম সেই সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করে ব‌সে।

দি‌নের পর দিন চ‌লে যে‌তে থাক‌লে বাধ্য হয়ে চান্দবী সমাজের আদালতে বিচার চায়। পুরুষ শাসিত চাকমা সমাজ নোয়ারামের পক্ষে রায় দেয়। প্রবঞ্চক নোয়ারাম সমাজের বিচারে চান্দবীর পেটের সন্তানের সাথে চান্দবীর সাথে সম্পর্কটিও অস্বীকার করে। পরে চান্দবী কার্বারী, হেডম্যান আদালত এমন‌কি রাজ আদালতেও ধর্না দিয়েছিলেন। বাচ্চা পেটে নিয়ে বিচার পাওয়ার আশায় ধর্না দিতে গিয়ে দিনের পর দিন অভুক্ত থাকতে হয়েছে তাঁকে। মাইলের পর মাইল পথ হাটতে হয়েছে একা। নৌ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে দিনের পর দিন।

শেষ অবদি কোথাও ন্যায় বিচার পাননি। বরং লাঞ্ছিত অপমানিত হ‌তে হয়েছে বারবার। একপর্যায়ে তার দাদা বলেছিল, “চান্দো তুমি বাচ্চা নষ্ট করো, বিচার চেয়ে লাভ নাই। কেউ জানবে না। আমরা তোমার ভাল জায়গাই বিয়ে দেব”। সে দাদার কথা শুনেনি। কাঁদতে কাঁদতে চান্দবী বলেছিলো, “দাদা এ বাচ্চাটি অবৈধ নয়, আমার পবিত্র ভালবাসার ফসল। কেন আমি তাকে হত্যা করব? তার কি দোষ!” চান্দবীকে খুব ভালবাসত দাদা। একটি মাত্র বোন ছিল চান্দবী। কিন্তু তাঁর কথা না শুনায় সেই দাদাও তাকে ত্যাগ করেছিল।

চান্দবী বারটি মাস বিশ্বাস করে অপেক্ষা করতেন তার প্রেমিক নোয়ারাম তার ভুল বুঝতে পেরে একদিন না একদিন তার কাছে ঠিকই ফিরে আসব‌ে।

একরাতে লাঞ্ছিত অপমানিত অসহায় চান্দবী লুকিয়ে গরু গোয়ালে প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে এক‌টি মৃত বাচ্চা প্রসব করে। সেদিন কেউ পাশে ছিল না তার। সে যখন প্রসব বেদনায় গগন বিদারী চিৎকার করছিল নিষ্ঠুর সমাজের কেউ এগিয়ে যায়নি। কেউ গিয়ে দেখেনি মেয়েটি কত অমানসিক কষ্ট পাচ্ছিল।

ভোর হতেই দেখল অপূর্ব সুন্দর দেবশিশুর মত একটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে সে। শিশুটিকে দেখে চান্দবী বলেছিল‌েন,

মরে গিয়ে বেঁচে গেলি কন্যা
সাথে এনে সাথে নিয়ে গেলি অসূচী
বেঁচে থাকলে সাথে থাকত নিত্য কত শাপ
এই জাতিতে নারী হয়ে জন্ম নেওয়া আজন্ম পাপ।

চান্দবীর শেষ পরিণতির কথা লোকমুখে শোনা যায়, ‘চান্দবীকে সামাজিক নিলামে তোলা হয়েছিল। ফুলচান চাকমা বা কালা মহাজন নামে এক বিত্তবান ব‌্যক্তি চান্দবীকে নিলাম থেকে কিনে নিয়ে বিয়ে করে অনেক দূরে চলে যান।

মুলতঃ চান্দবী আর নোয়ারাম পরস্পর ছি‌লেন মামা ভা‌গ্নি। চাকমা সমা‌জে এই সম্পর্ক অ‌নৈ‌তিক বা নি‌ষিদ্ধ প্রেমের সম্পর্ক। যা‌কে বলা হয় গর্বা কুদুম বা ‌বিবাহ করা যায় না এমন সম্পর্ক। সেই কার‌ণেই নোয়ারা‌মের সাহ‌সে কু‌লোয়‌নি সমা‌জের বিরু‌দ্ধে গি‌য়ে ভা‌গ্নী চান্দবী‌কে বি‌য়ে করার।

রূপবতী চান্দবী আর নোয়ারা‌মের প্রেম কা‌হিনী নি‌য়ে ধর্মধন প‌ন্ডিত রচনা ক‌রেছেন “চান্দবী বারমাস” না‌মে অ‌বিস্মরন‌ীয় এক কাব‌্য গ্রন্থ।

থেগামুখ অঞ্চ‌লে এখনও চান্দবীঘাট না‌মে এক‌টি গ্রাম আ‌ছে যেখানে চান্দবী তার মা‌কে নি‌য়ে বসবাস কর‌তেন। চান্দবী থেগা নদী পা‌ড়ে যে শিল পাথর‌টির উপ‌রে ব‌সে স্নান কর‌তেন সে পাথর‌টি এখনও আ‌ছে। এবং চান্দবী ঘাট গ্রা‌মে এখনও তার উত্তর সুরীরা বসবাস ক‌রেন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *