‘দুপুর থেকে মুহুরী নদীর পানি বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার দিকে গ্রামের পাশে নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। মুহূর্তেই পানিতে তলিয়ে যায় পুরো এলাকা, পানি ঢুকে পড়ে ঘরে। চোখের পলকে আমার ঘরটি নদীতে ভেঙে পড়ল। কোনোমতে মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়েছি।’
কথাগুলো বলছিলেন ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের উত্তর শ্রীপুর গ্রামের আলী আশরাফ। গতকাল মঙ্গলবার রাতে আশরাফ ও তাঁর ছোট ভাই আলী রাজের ঘর মুহুরী নদীতে ভেঙে পড়ে। বর্তমানে দুজন গ্রামে তাঁদের এক ভাগনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেই আজ বুধবার সকালে কথা হয় আশরাফের সঙ্গে।
কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে পানি বেড়ে যাওয়ায় উত্তর শ্রীপুরের মতো ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার ১৭টি স্থানে মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ ধসে পড়েছে। প্লাবিত হয়েছে অন্তত ৩৫টি গ্রাম। ফেনী সদর, ফুলগাজী ও পরশুরামে অন্তত ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। গতকাল রাত থেকে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সড়কটিতে ছোট-বড় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ।
আজ সকালে শ্রীপুর গ্রামে কথা হয় বাসিন্দা আরিফুর রহমানের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তাঁদের গ্রামে মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের অংশটি ২০২২ সাল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মেরামতের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যার কারণে গতকাল বাঁধের অন্তত ৪০ ফুট ধসে পড়েছে। এতে দক্ষিণ শ্রীপুর, বাসুরা, করইয়া, নিলক্ষী, গোসাইপুরসহ আশপাশের গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পাউবোর সূত্রে জানা যায়, মুহুরী নদীর পানি আজ সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
বন্যা মোকাবিলায় ত্রাণ ও দুর্যোগ শাখার সমন্বয়ে জেলা প্রশাসনের একাধিক দল বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২৪ ঘণ্টা বন্যাকবলিত এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণকক্ষ। ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেন জানান, এরই মধ্যে ফেনী সদর, পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার ১১৫টি পরিবারের ৩৪৭ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। আজ সকাল পর্যন্ত ১৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারিয়া ইসলাম বলেন, আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত ফুলগাজী উপজেলার ৭টি অংশে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙেছে। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে অন্তত উপজেলার ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী গ্রামের অনেক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
পরশুরামের ইউএনও আরিফুর রহমান বলেন, আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত পরশুরাম উপজেলায় মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ১০টি ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে মুহুরী নদীর ছয়টি স্থানে, কহুয়া নদীর তিনটি স্থানে ও সিলোনিয়া নদীর একটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙেছে। আজ সকাল পর্যন্ত পরশুরাম উপজেলার ১৫টি গ্রাম পানিবন্দী।
ফেনী পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ভারত সীমান্তবর্তী মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত দুই দিনে ৩টি নদীর অন্তত ১৫টি অংশে বেড়িবাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ফেনী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, বৃষ্টি বন্ধ হলে ও নদীর পানি কমলে ভাঙনকবলিত স্থানগুলোতে বেড়িবাঁধ মেরামতে কাজ শুরু হবে। নতুন করে যেন বেড়িবাঁধের আর কোনো স্থান না ভাঙে, সে জন্য পাউবোর কর্মকর্তারা তৎপর রয়েছেন।
আজ বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ফুলগাজী উপজেলার ৭টি অংশে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙেছে। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে অন্তত উপজেলার ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী গ্রামের অনেক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
বন্যা মোকাবিলায় ত্রাণ ও দুর্যোগ শাখার সমন্বয়ে জেলা প্রশাসনের একাধিক দল বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২৪ ঘণ্টা বন্যাকবলিত এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণকক্ষ। ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেন জানান, এরই মধ্যে ফেনী সদর, পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার ১১৫টি পরিবারের ৩৪৭ জন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। আজ সকাল পর্যন্ত ১৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে ফুলগাজী উপজেলায় ৯৯টি, পরশুরাম উপজেলায় ৩২টি ও ফেনী সদর উপজেলায় ২২টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় পরিচালিত কার্যক্রম তদারকিতে জেলা ও উপজেলায় ২ হাজার ৫৪৭ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন।
ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলার ৬ উপজেলায় ত্রাণকার্য পরিচালনায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় ৪০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলার ৬ উপজেলায় ত্রাণকার্য পরিচালনায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় ৪০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (উচ্চমান সহকারী) মো. মজিবুর রহমান বলেন, আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ফেনীতে ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে গতকাল দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় জেলায় সর্বোচ্চ ৪৪১ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়, যা চলতি ২০২৫ সালের বর্ষা মৌসুমে জেলায় সর্বোচ্চ বৃষ্টির রেকর্ড। আরও দুই দিন ফেনীতে মাঝারি থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০২৪ সালে আগস্টে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর সব উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এতে ২৯ জনের প্রাণহানি হয়। পানিবন্দী ছিলেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যানবাহন, ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রায় সব খাত। সেই বন্যায় প্রায় ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ২০ লাখ ৫০০ টাকার ক্ষতি হয়েছিল বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছিল।
প্রধান সম্পাদকঃ সারওয়ার খান
সম্পাদকঃ জাকের খান (রুবেল)
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫