জনসমর্থনে এগিয়ে যাচ্ছে জামায়াত

রাজনীতি

॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥

স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী কায়দায় ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়, রাজনৈতিক দলও নিষিদ্ধ করা যায়। কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই। কোনো আদর্শকে মোকাবিলা করতে হলে অবশ্যই তার চেয়ে উন্নত কোনো আদর্শ প্রয়োজন। রাজনীতি বিশ্লেষকরা এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে বর্তমান সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণ বিশ্লেষণ করে। তারা মনে করেন, আদর্শিকভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে সরকার নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীকে নির্মূলের যে পথে হাঁটছে, তা ভুল পথ। এমন ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক চরিত্র হারাচ্ছে; অপরদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়ছে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে দেশের সবচেয়ে বড় এ ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর অকথ্য নির্মম নির্যাতনের নতুন যে পর্ব ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী শুরু করেছে, তা অব্যাহতভাবে চলছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পল্টন মোড়ে সাপ মারার মতো লাঠি দিয়ে পিটিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৬ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে ক্ষমতা দখলের আগেই। এ নির্মম ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারের পর সারা দুনিয়ায় নিন্দার ঝড় ওঠে। নিউইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে সে দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় বিশ^বিবেক। এরই প্রেক্ষাপটে সেনাশাসিত মঈন উ আহমেদ ও ফখরুদ্দীন আহমেদের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতা দখল করে। সেই সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। ক্ষমতা দখলের পর তারা মেতে ওঠে দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নির্মূল করার নিমর্ম অপরাজনৈতিক খেলায়। সেই থেকে বিরামহীন অপপ্রচার, ভিত্তিহীন অভিযোগ, হয়রানি, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড, নির্যাতন, ফাঁসি, গুম, খুনসহ হেন কৌশল-অপকৌশল নেই, যা জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে না সরকার। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা পালন করা শান্তি, সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি ও সংহতির বার্তাবাহক হিসেবে জনগণের কাছে পরিচিত রাজনৈতিক দলটির নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন স্থগিত ও নির্বাচনী প্রতীক কেড়ে নেয়া নিয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও জামায়াতের জনসমর্থনে একটুও ভাটা পড়েনি। বরং দিন দিন ঈর্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর কারণ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শ।
আদর্শের মোকাবিলায় প্রয়োজন আরো উন্নত আদর্শ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশের সমাজে ধর্মের উপস্থিতি এবং প্রভাব নতুন কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইসলাম সবসময়ই এক ধরনের ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে সমাজ জীবনে ইসলামের দৃশ্যমান উপস্থিতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজের ইসলামীকরণ গত এক দশকে যতটা ঘটেছে, আগের কোনো সময়েই তা ঘটেছে বলে মনে হয় না। পোশাক-আচরণ দৈনন্দিন জীবনাচরণ-কথোপকথন এগুলোর দিকে তাকালেই সমাজে ও সংস্কৃতিতে ইসলামী ভাবধারার ব্যাপক প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। যা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত, তা হচ্ছে বাংলাদেশের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে যে স্থানীয় ও সমন্বয়বাদী (সিনক্রেটিজম) ইসলামের প্রাধান্য ও প্রভাব ছিল বলে ধারণা করা হতো, তার প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতক্রমে একটি রক্ষণশীল আক্ষরিক (লিটারালিস্ট) ব্যাখ্যা এবং একই সঙ্গে একটি বৈশ্বিক ব্যাখ্যার ইসলামেরই প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে এবং তা ক্রমবর্ধমান।’
একটি সূত্র জানায়, উদারপন্থী গণতান্ত্রিক ধারা ও ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য সমৃদ্ধ কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন এবং মানবাধিকারের সংরক্ষণ, মানষে মানুষে বৈষম্য দূর করে সব ধর্ম-বর্ণেও নাগরিকদের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। কিন্তু  অতীতের একটি রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে পুঁজি করে দলটিকে নিশ্চিহ্ন করতে হেন অত্যাচার-নির্যতান নেই, যা জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে চলছে না। বিশেষ করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ধারাবাহিকভাবে যে স্টিমরোলার চলছে, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে হত্যা করা হয়েছে জামায়াতের শীর্ষনেতাদের। দুর্নীতিমুক্ত-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের কারণে যাদের জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। তাদের জনকল্যাণমূলক কাজ জনগণকে আকৃষ্ট করছিল জামায়াতের পতাকাতলে। জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেয়ায় জনগণের আস্থা বাড়ছিল দ্রুতগতিতে। ষড়যন্ত্র আর সন্ত্রাসনির্ভর পেশিশক্তির পূজারি প্রতিন্দ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসররা জামায়াতে ইসলামীকে গণতান্ত্রিকভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দেয়ার নীলনকশা আঁকে। সেই নীলনকশার অংশ হিসেবে গত ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর রোববার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন স্থগিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আদালত দলটির নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) বিধান অনুসারে দলটির নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গেজেটে স্বাক্ষর করেছেন।
ইউকে, লন্ডনপ্রবাসী কাজী এম এ আনোয়ার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি বর্তমান সরকারের এ মানসিকতা প্রসঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘রাজনীতি ধর্মের নামে হয় না, হয় ধর্মীয় অনুশাসন বা নিয়মনীতির বাস্তবায়নের মাধ্যমে। তবে যদি কেউ কেবল রাজনৈতিক সফলতার জন্য ধর্মকে সামনে রেখে রাজনীতি করে, তাদের কথা ভিন্ন। ধর্ম জীবনের অংশ নয়; এটা জীবন ব্যবস্থা। পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিসে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে সব ধরনের বা সব ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া আছেÑ যাতে করে রান্নাঘর থেকে সংসদ পরিচালনায় কোনো অসুবিধা না হয়। বাংলাদেশেও হিন্দুইজম প্রতিষ্ঠায় হিন্দু রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিতি হয়েছে। ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন’ ও ‘বঙ্গসেনা’ নামে দুইটি রাজনৈতিক দল আছে বলে জানা যায়। ইন্ডিয়ায় মোট হিন্দু রাজনৈতিক দল হলো এগারোটা।’
তিনি আরো বলেন, ‘কিছু মানুষ যুক্তি দেনÑ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম হয় না, কারণ রাষ্ট্র তো আর মানুষ নয়। কী চমৎকার যুক্তি। রাষ্ট্রের ধর্ম হয় না, কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিকদের তো ধর্ম হয়। আর সেই রাষ্ট্রের নাগরিকরা যদি তাদের মানসিক শান্তির জন্যই হোক আর পরকালের শান্তির জন্যই হোক, কোনো একটা রাষ্ট্রধর্ম প্রত্যাশা করে, তাতে সরকারের কি কিছু করার আছে? সরকার শুধু সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারে। কেননা এটা গণতান্ত্রিক দেশ, এখানে জনগণই সঙ্কট মীমাংসার দাবি রাখে।’
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদকে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ টকশো চলাকালে একজন দর্শক জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন স্থগিত প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘কাগজে-কলমে একটি দলকে নিষিদ্ধ করা গেলেও আদর্শবাদী কোনো দলকে আসলে নিষিদ্ধ করা যায় না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে আদর্শ নিয়ে কাজ করছে, তার চেয়ে ভালো কোনো আদর্শ দিয়ে তার মোকাবিলা করতে হবে। অন্য যেকোনোভাবে নয়।’
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিষ্ঠিত সব রাজনৈতিক দলের অধিকার আছে জনগণের সামনে তাদের আদর্শ তুলে ধরার। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবেÑ কারা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। কোনো রাষ্ট্র বা সরকার কিংবা কমিশনের এক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার নেই। বরং সরকারের দায়িত্ব তাদের কর্মসূচি পালনে সহযোগিতা করা। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথের বাধাগুলো দূর করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর ব্যতিক্রম করার সুযোগ নেই। অন্যদিকে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসকরা ভিন্নমত সহ্য করে না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে সরকারের এমন আচরণকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলে বিবেচনা করা যায় না।

এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, দু-একটি জাতীয় পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে ‘জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করার’ যে তথ্য প্রচার করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন মামলাটি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকাবস্থায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল বলা সম্পূর্ণ অন্যায়, অযৌক্তিক ও বেআইনি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি বৈধ রাজনৈতিক দল। নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।’

উদার গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দলের আদর্শ
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এ প্রতিষ্ঠানের কাজ। কোনো রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং গণতন্ত্র ঠিক করে দেয়া তাদের কাজ নয়। উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনের এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৯। [(১)-এ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব-কর্তব্য ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এত বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী (ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; (খ) সংসদ-সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; (গ) সংসদে নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন; এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুত করিবেন।] (২) উপরি-উক্ত দফাসমূহে নির্ধারিত দায়িত্বসমূহের অতিরিক্ত যেরূপ দায়িত্ব এই সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে, নির্বাচন কমিশন সেইরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন।’
সূত্রে প্রকাশ, ‘২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন এক পত্রযোগে জামায়াতকে জানিয়েছিল যে, ক) দলটির গঠনতন্ত্রের ২ ধারার ৫ উপধারার আংশিক বিধান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব ও আইনসভার কর্তৃত্বকে অস্বীকারের সমতুল্য প্রতীয়মান হতে পারে। (খ) গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বর্ণিত ইসলামী সমাজ গঠন ও ধারা ৩-এ বর্ণিত ইসলামী জীবনবিধান কায়েমের বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে সংগতিপূর্ণ নয় (গ) গঠনতন্ত্রের ধারা ৫ উপধারা ৩-এ বর্ণিত ইসলামের সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম এবং ধারা ৬ ও উপধারা ৪-এ বর্ণিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠার বিধান বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। (ঘ) গঠনতন্ত্রের ধারা ৭ উপধারা ১-৪-এ বর্ণিত বিধান এবং ধারা ১১ উপধারা ২-এ বর্ণিত অমুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হওয়ার বিষয়টি বা অমুসলিম সদস্যের দলে সদস্যভুক্তির জন্য প্রস্তুতকৃত শপথনামা বাস্তবসম্মত নয়। গঠনতন্ত্রের এই দুটি বিধান আপনাদের দলের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক ও স্ববিরোধী। (ঙ) গঠনতন্ত্রের ধারা ১৮ উপধারা ৪ (চ)-এ বর্ণিত আমীরের মনোনয়ন প্রদানের ক্ষমতা Representation of the Peoples Order, 1972 (As amended upto date)-Gi Article 90 B(I) (b) (i) বিধানের পরিপন্থী। (চ) গঠনতন্ত্রের ৬৪ পৃষ্ঠায় বিশেষ নোটের দফা ৩ এ বর্ণিত বিষয়টি একটি ধারা আকারে দলের গঠনতন্ত্রে সন্নিবেশ করা প্রয়েজন।’

রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, জামায়াত কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী গঠনতন্ত্র সংশোধন করেছে। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের যে ধারা ও উপ-ধারাগুলোর ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংবিধানের দোহাই দিয়ে আপত্তি উত্থাপন করে দলটির গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য বলেছে, সে ধারা ও উপ-ধারাগুলোর প্রকৃত অবস্থা পাঠকদের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ২নং ধারার ৫নং ধারাটি আপত্তিকর বলে অভিহিত করেছে। এই ধারাটি হচ্ছে জামায়াতের মৌলিক আকিদা সংক্রান্ত। এতে জামায়াত “ইসলামের মৌলিক আকিদা…লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহÑ এই কালেমাকে জামায়াতের আকিদা হিসেবে গ্রহণ করেছে, যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল। জামায়াত এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছে এবং বলেছে যে, “এই আকিদার ‘প্রথমাংশ’ অর্থাৎ আল্লাহর একমাত্র ইলাহ হওয়া এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারুর ইলাহ না হওয়ার অর্থ এই যে, আকাশমণ্ডল এবং পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে, সেসব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক, মাবুদ এবং প্রাকৃতিক ও বিধিগত সার্বভৌম সত্তা হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। এসবের কোনো একদিক দিয়েও কেউ তার শরিক নেই।” এরপর বলা হয়েছে যে, ‘এই মৌলিক সত্য কথাটি জানিয়া ও মানিয়া লইলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অনিবার্যরূপে গ্রহণ করিতে হয়।’ এ অনিবার্য বিষয়গুলোর ৫ম বিষয়টির (৫ উপ-ধারা) ওপর নির্বাচন কমিশন আপত্তি উত্থাপন করেছে।

এই উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইনপ্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তার দেয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে। কেননা স্বীয় সমগ্র রাজ্যের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও সৃষ্টিলোকের সার্বভৌমত্বের অধিকার আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারো নাই।’ উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমানে যে সংবিধান বলবৎ রয়েছে, সেই সংবিধানটির মূল প্রস্তাবনাই শুরু হয়েছে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম অর্থাৎ দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। এর অর্থ যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে রাষ্ট্র আল্লাহর অনুগতই থাকবে এবং আল্লাহর নাম নিয়েই এ সংবিধানটি শুরু করা হয়েছে। এ সংবিধানের ২ (ক) ধারায় এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে। এ ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে। এই সংবিধানের ৪১ ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। এবং খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের উপরোক্ত বিধানগুলো সামনে রেখে যদি নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের তথাকথিত আপত্তিকৃত ধারা-উপধারাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে আমাদের জাতীয় সংবিধানের সাথে এর সংঘাত-সংঘর্ষের কোনো বিষয়ই নজরে পড়ে না।

পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, সংবিধানের কোথাও কোনো রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেয়া হয়নি এবং দুনিয়ার কোনো দেশেই নির্বাচন কমিশনের কথামতো কোনো রাজনৈতিক দল উঠবস করে না। নির্বাচন কমিশন জনগণের নির্বাচিত কোনো সংস্থাও নয়। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক দলগুলো হচ্ছে জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তাদেরই আদর্শে অনুপ্রাণিত জনকল্যাণের জন্য নিবেদিত জনগণেরই একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার। একেকটি রাজনৈতিক দলের একেক রকম উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি থাকতে পারে। জামায়াতে ইসলামীরও আছে। জামায়াত তার গঠনতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সংবিধানে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে। জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে সংবিধানের ৪১নং অনুচ্ছেদ কতিপয় অধিকারও প্রদান করেছে এবং যেটা হচ্ছে ধর্মীয় স্বাধীনতা। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো যা বলছে এবং করছে, তা ধর্মীয় স্বাধীনতারই অংশ। ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হবে না। বরং স্বাধীন নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং ভোটে অংশগ্রহণে বাধাদানের অপরাধের দায় তাদের ওপর বর্তাবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *