হজের মৌসুম এলে হৃদয়পটে যার স্মৃতি ঝলমল করে, তিনি জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)। তার আনুগত্যের অনুশীলন হয় হজ ও কোরবানিতে। ত্যাগ, আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন সফলতার শীর্ষ চূড়ায়। ফলে আল্লাহতায়ালা তাকে বানিয়েছেন মানবজাতির ইমাম। তার ত্যাগী জীবনের প্রতি আমাদের উৎসাহিত করেছেন স্বয়ং আল্লাহ পাক। তিনি পবিত্র কোরআনে স্থানে স্থানে তার আলোচনা করেছেন। হিসাব করে দেখা গেছে, ২৫টি সুরায় ৬৩টি আয়াতে তার আলোচনা স্থান পেয়েছে।
শৈশবেই স্রষ্টার পরিচয়
আল্লাহতায়ালা সমস্ত পয়গম্বরকে শৈশবকাল থেকেই স্বীয় তত্ত্বাবধানে গড়ে তুলেছেন। সমাজের অন্য ছেলেমেয়েদের থেকে তাদের জীবনাচার ছিল ভিন্ন। খেলাধুলা, ঝগড়াঝাঁটি, উচ্ছৃঙ্খল ও পাপ-পঙ্কিলতার ছোঁয়া থেকে তারা ছিলেন মুক্ত। সমাজের মানুষের মুক্তির চিন্তা শৈশব থেকেই নবীরা লালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ইবরাহিম (আ.)-এর কথা আল্লাহপাক কোরআনে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি শৈশব থেকেই ইবরাহিমকে হেদায়েত দান করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ৫১)
শৈশব বয়সেই সমাজের মানুষকে মূর্তিপূজা করতে দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হন। আপন স্রষ্টার সন্ধানে তিনি দৃষ্টি বোলাতে থাকেন সৃষ্টিরাজির প্রতি। একদিন রাতেরবেলা আকাশের চাঁদ অবলোকন করে বলে ফেললেন, এটা আমার রব। কিন্তু সে চাঁদ অস্তমিত হয়ে যাওয়ায় তিনি বুঝলেন, চাঁদ কখনো প্রভু হতে পারে না। প্রভু তো তিনি হবেন, যার লয় নেই, ক্ষয় নেই। যিনি ছিলেন, আছেন, থাকবে অনন্তকাল। এভাবে মেধা ও চিন্তাশক্তি কাটিয়ে তিনি চিনে ফেললেন আপন রবকে। বলে উঠলেন, ‘যিনি আকাশ, জমিন, চন্দ্র, সুর্য সৃষ্টি করেছেন তিনিই আমার প্রভু। আমি তার প্রতিই মনোনিবেশ হচ্ছি। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’
তাওহিদের আহ্বান
সব নবীই মানুষকে তাওহিদের প্রতি আহ্বান করেছেন। কিন্তু ইবরাহিম (আ.)-এর আহ্বান ও দাওয়াতের পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। তিনি যে সমাজে জন্মলাভ করেছিলেন, সে সমাজের সবাই মূর্তিপূজা করত। মূর্তির প্রতি তাদের ভালোবাসা ও আসক্তি ছিল মজ্জাগত। তিনি পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে শিরকের বিরুদ্ধে নেমে পড়েন। যুক্তির আলোকে মূর্তির অসাড়তা তুলে ধরে কওমকে তাওহিদের দিকে দাওয়াত দিতে শুরু করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি লোকদের ইবরাহিমের ঘটনা পাঠ করে শুনিয়ে দিন, যখন তিনি আপন পিতা ও জাতিকে বললেন, তোমরা কীসের উপাসনা করো? তারা জবাব দিল, আমরা দেবতার উপাসনা করি, তাদের কাছে বসে থাকি। ইবরাহিম (আ.) বললেন, তোমরা যখন তাদের আহ্বান করো, তখন তারা কি তোমাদের ডাক শোনে? কিংবা তারা তোমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে সক্ষম? তারা বলল, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষকে এমন করতে দেখেছি।’ (সুরা শুয়ারা : ৬৯-৭৪)
অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ
দাওয়াতের কাজে সব নবীকে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইবরাহিম (আ.)-এর নির্যাতনের মাত্রা ছিল ভিন্ন। তার সম্প্রদায় ও নমরুদ সিদ্ধান্ত নিল, তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে। এক মাস পর্যন্ত শহরবাসী জ্বালানি সংগ্রহ করে তাতে আগুন জ্বালাল। অবিরাম সাত দিন পর্যন্ত জ্বলতে জ্বলতে যখন ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে, তখনই আল্লাহর পয়গম্বর ইবরাহিমকে তাতে নিক্ষেপ করা হয়। একজন জীবিত মানুষকে আকাশছোঁয়া আগুনে নিক্ষেপের কথা কল্পনা করা যায়! জালিমরা তাই করল। কিন্তু আল্লাহতায়ালা তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন। তিনি আগুনকে বলে দিলেন, যেন ইবরাহিমের জন্য শান্তিদায়ক ঠান্ডা হয়ে যায়। ইবরাহিম (আ.) বলতেন, ‘নমরুদের আগুনে আমি যে সুখ ভোগ করেছি, তা জীবনে কখনো ভোগ করিনি।’
স্বদেশ ত্যাগ
দ্বীনের জন্য প্রায় সব নবীই মাতৃভূমি ত্যাগ করেছেন। কিন্তু ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ একটু ব্যতিক্রম। তিনি কোনো দেশেই স্থির হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেননি। জন্মভূমি ইরাক ছেড়ে চলে গেলেন সিরিয়ায়। সেখান থেকে দাওয়াত দিতে দিতে যান মিসরে। সেখানে অবস্থান শুরু করতে না করতেই বিবি হাজেরাকে নিয়ে মক্কায় স্থানান্তর করেন আল্লাহর নির্দেশে। সেখানে পৌঁছেই সম্মুখীন হন কঠিনতম পরীক্ষায়। আদরের একমাত্র শিশুপুত্র এবং স্ত্রীকে মক্কার জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে রেখে চলে আসার নির্দেশ পেলেন তিনি। আল্লাহর নির্দেশই তার কাছে সবচেয়ে বড়। তাই অবলা স্ত্রীর পেছন পেছন আগমন আর তার সকাতর অভিব্যক্তি বাধা হতে পারেনি তার অভিযাত্রা থেকে। এভাবে দেশ-দেশান্তরে দাওয়াতের কাজে কেটেছে তার পুরোজীবন।
আদরের পুত্রকে কোরবানি
ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাটা এসেছে পুত্র কোরবানির নির্দেশের মাধ্যমে। তাও স্বপ্নযোগে। এ ক্ষেত্রেও তিনি চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে সফল হয়েছেন। আল্লাহর কাছে ছেলে কোরবানির রহস্য জানতে চাননি। স্বপ্ন বলে বিষয়টি উড়িয়েও দেননি। বরং ছেলেকে নিয়ে চললেন মিনা প্রান্তরে। হাত-পা বেঁধে উপুড় করে শুইয়ে সন্তানের গলায় চুরি চালালেন। সহসা শুনতে পান আসমানি আওয়াজ। আল্লাহ ডেকে বললেন, ‘হে ইবরাহিম, তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছো। নিশ্চয় এটা ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা।’ )(সুরা সাফফাত : ১০৬)
ইবরাহিম (আ.) অসীম ত্যাগ ও কোরবানির বদৌলতে পেয়েছেন অশেষ পুরস্কার। আল্লাহতায়ালা তাকে খলিল উপাধিতে ভূষিত করেছেন। মানবজাতির ইমাম বা নেতা মনোনীত করেছেন। দুনিয়া ও আখিরাতে পরিয়েছেন সম্মানের রাজমুকুট। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তাকে দুনিয়াতে দান করেছি কল্যাণ এবং তিনি পরকালেও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।’(সুরা নাহল : ১২২)
মুসলিম জাতির স্থপতি
ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের প্রধান ব্রত ছিল আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিঃসংকুচ আত্মসমর্পণ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘স্মরণ করুন ওই সময়ের কথাÑযখন ইবরাহিমকে তার প্রভু বললেন, আত্মসমর্পণ করো, সে বলল, আমি জগতের প্রতিপালকের সামনে আত্মসমর্পণ করলাম।’ (সুরা বাকারা : ১৩১)
ইবরাহিম (আ.)-এর সমগ্র জীবনে ত্যাগ ও আত্মসমর্পণের অনুপম দৃষ্টান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে। জীবনের পদে পদে তিনি আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজেকে সঁপে দিয়ে মুসলিম জাতির স্থপতি হিসেবে অভিহিত হয়েছেন। কারণ, মুসলিম অর্থ আত্মসমর্পণকারী। অর্থাৎ যে নিজেকে আল্লাহর নির্দেশের সামনে সঁপে দেয় সে-ই মুসলমান। এ ক্ষেত্রে ইবরাহিম (আ.) বিশ্ববাসীর সামনে উজ্জ্বল নমুনা এঁকে বরণীয় হয়েছেন। তাই আল্লাহপাক তার মিল্লাত ও আদর্শের অনুকরণের নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের। তিনি বলেন, ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিমের মিল্লাতের অনুসরণ করো। তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলমান।’ (সুরা হজ : ৭৮)
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম সাতাইশ, টঙ্গী
শেয়ার করুন