জুলুম-অত্যাচার ইসলামের দৃষ্টিতে একটি জঘন্য অপরাধ। জুলুমকারীকে সবাই ঘৃণা করে। এর কারণে পার্থিব জীবনে মানুষ হবে লাঞ্ছিত এবং পরকালে ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি।
এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘জালিমদের জন্য পরকালে কোনো দরদি বন্ধু থাকবে না এবং তাদের জন্য কোনো সুপারিশকারীও হবে না, যার কথা মান্য করা হবে।’ (মুমিন, ১৮)।
অন্যত্র তিনি আরও বলেন, ‘জালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।’ (হজ, ৭১) উপরোক্ত আয়াত দুটিতে আল্লাহ একে অপরের ওপর অত্যাচার করা হতে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ অত্যাচারীর জন্য কেয়ামতের দিন কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। সেদিন তার অত্যাচারের সমপরিমাণ নেকি অত্যাচারিত ব্যক্তিকে প্রদান করতে হবে। যা হবে তার জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। এ জন্য জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত থাকতে হবে।
আল্লাহতায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘শুধু তাদের ওপর দোষারোপ করা হবে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা ৪২)
তিনি অন্যত্র বলেন, ‘কিন্তু তারা ব্যতীত যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং আল্লাহকে বারবার স্মরণ করে ও অত্যাচারিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে। অত্যাচারীরা শিগগিরই জানবে তাদের গন্তব্যস্থল কোথায়।’ (শু‘আরা ২২৭)
তিনি অন্যত্র আরও বলেন, ‘আর এরূপেই তিনি কোনো জনপদের অধিবাসীদের পাকড়াও করেন যখন তারা অত্যাচার করে; নিঃসন্দেহে তাঁর পাকড়াও হচ্ছে অত্যন্ত কঠিন।’ (হুদ ১০২)
তিনি অন্যত্র আরও বলেন, ‘অতঃপর যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছল, আমি ওই ভূখন্ডের উপরিভাগকে নিচে করে দিলাম এবং এর ওপর পাকা মাটির পাথর বর্ষণ করতে লাগলাম, যা অবিরাম ছিল।’ (হুদ ৮২)
এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে- হজরত জাবির (রাজি.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেলেন : তোমরা অত্যাচার করা হতে সাবধান থাক। নিশ্চয়ই অত্যাচারীর জন্য কেয়ামতের দিন হবে অন্ধকার। তোমরা কৃপণতা থেকে বেঁচে থাক। কৃপণতা তোমাদের আগের জনগণকে ধ্বংস করেছে। কৃপণতা তাদের অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা করার প্রতি এবং হারামকে হালাল করার প্রতি উৎসাহিত করেছিল। (মুসলিম, মিশকাত হা/১৮৬৫; বাংলা মিশকাত, চতুর্থ খন্ড, হা/১৭৭১ জাকাত অধ্যায়)
অপর একটি হাদিসে এসেছে- হজরত আবু হুরাইরা (রাজি.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেলেন : কারও ওপর তার ভাইয়ের যদি কোনো দাবি থাকে, মান-ইজ্জত অথবা অন্য কোনো কিছুর ওপরে জুলুম সম্পর্কিত তাহলে সে যেন ওই দিন আসার আগেই তার থেকে মাফ করিয়ে নেয়, যেদিন কোনো অর্থ-সম্পদ থাকবে না; বরং যদি কোনো নেক আমল থাকে তাহলে জুলুম পরিমাণ, তা নিয়ে নেওয়া হবে। আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে তাহলে তার পাওনাদারের গোনাহের বোঝা নিয়ে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। (বুখারি, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৯৯)
উপরোক্ত হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, অত্যাচারী ব্যক্তি কেয়ামতের কঠিন অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। আর সেই অত্যাচার যে কোনো ব্যাপারে হোক না কেন। আচার-আচরণ, কথাবার্তা, লেনদেন ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ে হোক না কেন। জুলুম হয়ে গেলে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে নইলে পরকালে নেকির মাধ্যমে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আর নেকি না থাকলে অত্যাচারিত ব্যক্তির গোনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। পাপের বোঝা নিয়ে অত্যাচারীকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে হবে।
সহিহ বুখারির অন্য বর্ণনায় আছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুআজকে বললেন : হে মুআজ! মজলুমের অভিশাপকে ভয় করবে। কেননা তার মাঝে ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না। (বুখারি, হা/২২৬৮; মুসলিম, তিরমিজি হা/১৯৩৭)
হজরত আবু হুরাইরা (রাজি.) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা বলতে পার সবচেয়ে নিঃস্ব কে? সাহাবিগণ বললেন, আমাদের মাঝে সবচেয়ে দরিদ্র সেই যার কোনো অর্থ ও উপকারী বস্তু নেই। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : আমার উম্মতের সবচেয়ে গরিব এমন ব্যক্তি যে সালাত, সিয়াম ও জাকাতের নেকি নিয়ে কেয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে।
অন্যদিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, অন্যায়ভাবে সম্পদ ভক্ষণ করা, অপবাদ দেওয়া ও গালি করার অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত হবে। তখন তার নেকি থেকে তাদের পরিশোধ করা হবে। তার নেকি শেষ হয়ে গেলে তাদের পাপ নিয়ে তার ওপর চাপানো হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম, হা/৪৬৭৮; মিশকাত হা/৫১২৮)
ওই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অন্য মানুষের ওপর অত্যাচারে হক নষ্ট করা হয়, যা পাপের অন্তর্ভুক্ত। এটার দায় কেয়ামতের দিন নেকি দিয়ে পরিশোধ করতে হবে।
হজরত আবু মুসা (রা) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারীকে এক নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে তাকে যখন পাকড়াও করেন, তখন তাকে আর ছাড়েন না। অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করলেন তোমার প্রতিপালকের ধরা এইরূপ যে যখন তিনি অত্যাচারী জনপদকে পাকড়াও করেন, তাঁর ধরা কঠিন। (মুত্তাফাক আলাইহ্, বুখারি হা/৪৩১৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৯৭)
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক
শেয়ার করুন