জৈন্তাপুরে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব

সিলেট

সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তে শূন্যরেখা এবং আশপাশের এলাকায় অবৈধভাবে টিলা কেটে পাথর উত্তোলন করছে একটি প্রভাবশালী চক্র। স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তাকে হাত করেই চলছে এই অবৈধ কর্মকাণ্ড। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হাত করার নামে দিনে ১০ লাখ টাকার বেশি চাঁদা আদায় করে চক্রটি। চক্রের সবাই ক্ষমতাসীন দলে সম্পৃক্ত।

জৈন্তাপুরের একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্য জানান, যে জায়গা থেকে পাথর তোলা হয়, তার একটি বড় অংশের মালিক ব্লু প্লানেট গ্রুপ (বিপিজি)। ব্লু প্লানেট হসপিটালিটি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলমের মদদে জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল আহমদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রাজার নেতৃত্বে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হয়।

তাঁদের সঙ্গে আরও আছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদের পিএ (ব্যক্তিগত সহকারী) সাইফুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম লিয়াকত আলী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহিবুর রহমান মেম, সাংগঠনিক সম্পাদক হানিফ মোহাম্মদ ও কামরুজ্জামান চৌধুরী, উপদপ্তর সম্পাদক জাকারিয়া মাহমুদ, উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। তাঁরা কেউই অবশ্য নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেননি।

নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে এম লিয়াকত আলী ও জাকারিয়া মাহমুদ দাবি করেন, উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক রাজাসহ একটি চক্র এই কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, ‘২০২০ সাল থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ আছে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় টুকিটাকি উত্তোলনের চেষ্টা করলে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ করি। এবার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগে তারা সেই চেষ্টা করলে আগের মতো শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারিনি। এই সুযোগে ভালো করেই পাথর উত্তোলন শুরু করে এবং ধরে নিয়েছিল, এভাবে করতেই থাকবে। পরে আমরা বিভিন্ন জায়গায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল-জরিমানাও করেছি। শ্রীপুরের বিষয়টা চলতি মাসের শুরুর দিকে নজরে এসেছে। আমরা শক্ত অবস্থান নিয়েছি। এরপর থেকে এসব টোটালি বন্ধ।’

গত সোমবার জৈন্তাপুর উপজেলায় সীমান্তের শূন্যরেখায় গিয়ে শ্রমিকদের পাথর তুলতে দেখা যায়। পাথর উত্তোলনরত কয়েকজন শ্রমিক জানান, তাঁরা মাথায় পাথর বহন করলেও বিক্রি করেন নৌকার হিসাবে। প্রতি নৌকা বড় পাথর ৯০০ টাকা পান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, ‘অবৈধ জানি, কিন্তু পেটের দায়ে করি। আর মহাজনরা প্রশাসন ম্যানেজ করেন।’

চারজন ট্রাকচালক জানান, রাজা, জব্বার, তানভীর, জিসান, কয়েছ, সাইফুল ইসলাম বাবু, সালেহ চক্রের লোকজন বড় ট্রাক থেকে ৫ হাজার ও ছোট ট্রাক থেকে আড়াই হাজার টাকা করে নেন। প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ-বিজিবি ও নেতাদের কথা বলে ওই টাকা নেওয়া হয়।

জৈন্তাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘পাথর উত্তোলন নিয়ে একাধিকবার উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে বলেছি। কোনো কাজ হয়নি।’ নিজপাট ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইন্তাজ আলী বলেন, ‘দিনে পাথর তোলে, রাতে ট্রাকে করে নিয়ে যায়। প্রশাসনকে ফোন করলেও তারা আসে না।’

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রিসোর্ট বানানোর কথা বলে ২০০৯ সালে ব্লু প্লানেট হসপিটালিটি লিমিটেডের নামে ৩০০ বিঘার বেশি জমি কেনা হয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত লিয়াকত আলী ওই জায়গা থেকে পাথর তুলতেন। কামাল আহমদ ও লিয়াকতের বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষে এক প্রবাসীর মৃত্যুর পর লিয়াকত সরে দাঁড়ালে শাহ আলমের মাধ্যমে ঢোকেন কামাল ও রাজা।

হেনরি লামিনের সুপারি জুমের ম্যানেজার বকুল বলেন, ‘যেখান থেকে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে, সেটি আরিফ সাহেবের জায়গা।’ অ্যাডভোকেট এ এইচ ইরশাদুল হক বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় ২০১৮ সালে ওই জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে আমরা আদালতের শরণাপন্ন হলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। আদালতের আদেশ অমান্য করেই চলছে পাথর উত্তোলন।’

এম লিয়াকত আলী বলেন, ‘কামাল ও রাজা ওই জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন করছেন। শাহ আলমের মাধ্যমে জায়গার মালিক আরিফ সাহেব নাকি ২৫ ভাগ নেন। বাকিটা কামাল ও রাজার।’

অভিযোগ অস্বীকার করে শাহ আলম বলেন, ‘এখানে পাথর উত্তোলনই হচ্ছে না। প্রয়োজনে ইউএনও, এসি ল্যান্ডকে জিজ্ঞেস করুন।’

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লিয়াকত আলীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত আব্দুল জব্বার, জৈন্তাপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মানিক মিয়া, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের নেতা নাছির উদ্দিন, পুলিশের লাইনম্যান শফিকুল ইসলাম শহিদ, উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী জামান, হেনরি লামিনের ম্যানেজার বকুল, জিসান আহমেদ, তানভীর আহমদ প্রমুখ পাথর উত্তোলন চক্রে জড়িত। চক্রটি সোমবার রাতেও আদর্শগ্রাম ঘাট থেকে ২০০ ফুটের ১৯৬ গাড়ি পাথর বিভিন্ন মিলে পাঠায়।

অন্যরা নিজেদের সম্পৃক্তার কথা অস্বীকার করলেও আব্দুল জব্বার বলেন, ‘নদী থেকে তুইয়া (কুড়িয়ে) কিছু পাথর তোলে। তারা (শ্রমিক) গরিব মানুষ। একটু সহযোগিতা করি। সহযোগিতা করতে গিয়ে অযথা দুটি মামলার আসামি হইছি। আমার গাড়ি ও ড্রাইভারকে ধরে নিয়ে গেছে। এখন ১৫ দিন বন্ধ।’

নাছির উদ্দিন বলেন, ‘তিন মাস আগে মাঝেমধ্যে নিতাম। নিষেধ দেওয়ার পর থেকে বন্ধ। মঙ্গলবার রাতেও গোয়াবাড়ী থেকে বড় ট্রাকে ১০ ট্রিপ পাথর বের হয়ে গেছে। বড় বড় গর্ত হচ্ছে। একটা সিন্ডিকেট ব্যবসা করতেছে। পুলিশ ও ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে কোনো লাভ হয়নি।’

চক্রের মূল হোতা আব্দুর রাজ্জাক রাজার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলেন। সম্প্রতি পাথরখেকো চক্রের ৫ জনের নামোল্লেখ করে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়। এর আগে উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নেতৃত্বে গঠিত কমিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ‘ম্যানেজ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এদের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স। আমরা অভিযানের মাধ্যমে জরিমানা, মামলা করেছি। তদন্ত চলছে।’

জৈন্তাপুর থানার ওসি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে পাথর উত্তোলন এখন বন্ধ। দুটি মামলা করেছি। জড়িতদের গ্রেপ্তারও করেছি।’

জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘শ্রীপুরের বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। প্রশাসন, পুলিশ—সবাই সতর্ক আছি। সব জায়গায় আমাদের অভিযান চলে।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *