জোঁকের আবাদ-খোকন সরকার

কবিতা

সহকারী শিক্ষক
উত্তরা মডেল স্কুল এন্ড কলেজ,ঢাকা

আগে এক সুময় সূর্য উঠতো
ডগ ডগে ডিমের কুসুমের মতো
থক থকে নরোম শান্ত সকালে।
ক্রমে বাড়তো আলো, তাপ, খরা
আর তাতে লুহা জুড়ানে ঝলকানি মাত্তো- বুক থেকে মনে, মন থেকে মাথায় যা শক্তি হয়ে ফুটে পড়তো
পাকা ধানের পুরু পুরু ছড়ার মধ্যে।
সারা বিলে সোনার কুচি ছড়ানো,
উঠোনে মাচায় ঝিঙে ফুলের আগুন,
দাওয়া থেকে নামতে সন্ধ্যা মালতী
মন থেকে মুখে সবার বিয়ান বেলার ঝরে পড়া শিয়েলী ফুলের হাসি
সে কি আনন্দ! তেরো পার্বন লাগানো
সারা বছর জুড়ে
চারিদিকে রঙিন কাপড়ের উড়া উড়ি।
তবে কি, সুখের পরেও সুখ দেখলো
খোলা চুল উড়িয়ে ঝাঁপানো নদীর পরে মার- বান্দা ভবদহ গেট ?
ভবদহ ! কি দাপট ছিল ঐ জগৎ দুয়ার পাকের মধ্যি। দাপানি মারে
পড়তো আসে ভাসায় ফেলতো
বিল খাল। আগের মানষি কতো, এ জল আমাগে সুখ দুখির বাত্তা নিয়ে
সাগরে ফিরে যায় গো। সে উছলা ধেয়ে চলার চোখে কালো কাপড়ের পটি বেধে দিলো।

চুল কিছু দিন ঢেউ তুলে উড়লো,
এখন তেল-জটা হয়ে যেন লুহার গজাল লাঠি।
যা তুলতে-বানতে কষ্ট, টানতে- বইতে কষ্ট
রঙ চটা হয়ে আসলো পরনের কাপড়
দিনের আলো, রাতের জোনাক পোকাও মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
মাটি নেই, ধান নেই, থইথই জল আর জল। দুঃখ কষ্টের স্রোত এখন শুধু চারি পাশে পাক খায়।
অনেক দেন-দরবারের পরে খবর আসলো
বড় মিটিং হবে অঞ্চালে, শুনা গেলো
চাষাগে সুহৃদ আসবে সভায়।
জট কাটার বন্দোবস্তর, ধান ফসলের কথা
ঝাঁপানো নদীতে আগের ঢেউ উঠবে,
কতো কিছু হবে।
হাজির হতে থাকলো মাজা সুমান
কাদা-জলে থাকা মানুষ গুলোন।
সকালের ভাতের সানক দুপুরে নিয়ে বসা কৃষক ঢেলে রেখে হাঁটলো-
আগে বিল, তার পরে না খাওয়া।
সভা বসবে, মিটিং হবে ধান ফসলের কথা, উঠোনের জমানে জল,
সব সমাধা হবে।
উঠতি চলতি বয়েসীরা চুটলো সব
সাদা জামার সাহেব বাবু দেখতে
ছোটোরা দোড়োলো যেন লজেন কাটির লোভে।
বয়েসের শেষ, আশার কথা শুনতে
হাতের লাঠি টান’দে ফেলায়
পড়ি মরি করে হাঁটলো শশধর বুড়ো,
কত ব্যস্ত! কিন্তু কৃষক বসার জাগা কই ? সাহেব বাবু’দে বোঝাই হয়ে বসা।
বড় বড় বুদ্ধির মাথা পানির সাহেব,
মাছের সাহেব ধান, মাছ, জল নিয়ে
কত কথা কইলেন –
তয় জলের জট তো কাটতি পাললে না।
এ ওর দিকে মুখ চাওয়া,
কুঞ্জো মোড়লের মাথায়ও আসলে না
পাশে বসা সত্য ঢালী, কপালে দিসে-হারা চিন্তার ভাজ কয়, ঠাওরালাম না, বান্দা- পানিতি টাহা আসপে !
না, এখনো বাকী বড় চেয়ারের সাহেব
সবারই চোখ সে দিকি।
এবার দাঁড়ালেন তিনি, চাষার জন্যি বিগলিত প্রাণ, কৃষক খেলে সবাই খায়, কৃষক হাসলে দেশ হাসে কৃষক বাঁচলে দেশও বাঁচে।
চড়-বড় চড়-বড়! কিলাব, কিলাব আর কিলাব
সাহেবতো কথাই বলতি পারে না।
চাষার এতো আনন্দ !
অঞ্চালের বড় বাবু হাত তুললেন-
সবাই এবার থামো !
দাঁড়ালেন সাহেব, মুখ ভেজা হাসা দিয়ে কইলেন – ধান না, জল না,
কৃষকের হাসির জন্য চাষ হবে জোঁকের।
হাত উঁচু করে সাহেব ক্লুপ দিলেন সবার মুখে
কৃষকের চাই টাকা যাতে জীবনের সব কিছুর মিমাংসা হয়।
জোঁক না কি বড় বড় সাহেবরা কিনে কিনে খায়, দূরির মুল্লুকি রপ্তানি হয়।
গিরিধর মাতবর, হোচেন গাজী খোদ চাষার পো
মাটির রস, শরীরির রক্ত অদল বদল সম্পর্ক
লাফায় উঠলো, সাহেব বাবুরা ! নদীর প্যাট’টা খোলোসা বানায় দেও, নদী বিল জলে ঝাঁপা- ঝাঁপি করুক, টায়া চাইনে।
হলো না ! গেঁয়ো কথার অর্থ বোঝলে না সাহেবরা,
ভাঙা মাচানে ঝিঙের নতুন টেঙরি ছাড়বে, সাঁজের সুমার মালতীর রঙ,
সকালের ঝরা ফুল, যেন আঁশটে গন্ধে হারায় গেলো।
এ সব কথা ভাবা দেহার বুক চোখ সাহেবগে থাহে না।
সবাই কাটে ফেলা গাছের গুড়ার মত বালির বস্তা হয়ে গেলো
হাড় খাটা মানুষ গুলোন হা হয়ে থাকলে।
খাঁজুর গাছের নলেন রস জিবে স্বাদ আনে গলে গেলো মন।
বহু দিন বিলে জল ফসলের ক্ষেত
তবে, জোঁকের চাষ হয় না, জন্মায়।
অনেক, অনেক আর অনেক-
কই, সাহেবরা তো খায় না ! বিদেশেও যায় না !
হ্যাঁ, খবরের পাতায় লিখলো সে দিন বাবু সাহেবরা জোঁক খায় না,
খায় জোঁকের চোষা রক্ত।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *