জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তি পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা

জাতীয়

এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে পৌনে ৩৯ শতাংশ মূল্য কমার পরও দেশের অভ্যন্তরে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করার পেছনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। আর এ ব্যাপারে আইএমএফের ভর্তুকি প্রত্যাহারের পরামর্শ যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হলেও সরকারের পদক্ষেপের সাথে এই দাতা সংস্থার পরামর্শের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। অধিকন্তু সংস্থাটির জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে সংস্কারের পরামর্শ উপেক্ষা করে একতরফা মূল্য বৃদ্ধিতে আইএমএফ কর্মকর্তারাও বিস্মিত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এ দিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা এবং রাজস্ব আয় ব্যয় ও জাতীয় হিসাবগুলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হলে সরকারি যন্ত্রের মূল সমস্যা কোথায় তা উন্মোচন হতে পারে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুসরে, গতকাল ৮ আগস্ট ২০২২ আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ১০৬ ডলার। বিদ্যমান বিনিময় হার অনুসারে এতে প্রতি লিটার তেলের দাম পড়ে ৬৪ টাকা। এক বছর আগে ১ আগস্ট ২০২১ তারিখে প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত তেলের দাম ছিল ১৭৩ ডলার ৫৭ সেন্ট। তখনকার বিনিময় হার অনুসারে বাংলাদেশী টাকায় প্রতি লিটার জ্বলানি তেলের দাম পড়ে ৯২ টাকা ৩৩ পয়সা। এই মূল্য ১ মার্চ ২০২০ ছিল প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলার ২০ সেন্ট, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় পড়ে ৩৭ টাকা ৩৪ পয়সা।

গত বছর আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পর্যায়ে উঠে যাওয়ার পর তা আবার নিচে নেমে আসে। আর রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলার পর জ্বালানি তেলের দাম আবার বাড়তে শুরু করে। কিন্তু বাইডেনের সৌদি আরবের জেদ্দাতে উপসাগরীয় দেশগুলোসহ ৯ আরব দেশের সম্মেলনের পরে তেলের দাম আবার কমতে শুরু করে। ৭ আগস্ট এসে সরকার আকস্মিকভাবে জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় এবং যুক্তি দেখায় যে ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য এই মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ হিসাব করে দেখিয়েছেন, বিশ্ববাজারে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১০৬ ডলার হিসাবে বাংলাদেশী টাকায় দাম পড়ে ৬৪ টাকা। ১ মার্চ ২০২০ সালে এই দাম ছিল ৫৬ টাকা, ১ ডিসেম্বর ২০২০ ছিল ৩৭ টাকা, ১ জানুয়ারি ২০২১ ছিল ৪৮ টাকা আর ১ ডিসেম্বর ২০২১ ছিল ৯২ টাকা। এ হিসাবে বর্তমান বিশ্ববাজারে ডলারে জ্বালানি তেলের দাম ৩৯ শতাংশ এবং টাকার হিসাবে ৩৩ শতাংশ কমে এসে গেছে। এ হিসাবে আমদানি মূল্য বিবেচনা করা হলে কোনো সময় ভর্তুকি দিতে হয়নি বিপিসিকে। আইএমএফ যদি জ্বালানি তেলে ভর্র্তুকি তুলে দিতে বলে তাহলে বর্তমান অবস্থায় এর দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না।

তবে আইএমএফের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, সংস্থা সরকারকে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে সংস্কার আনার পরামর্শ দিয়েছে। তারা বলেছে, জ্বালানি তেলে ভর্তুকি না দিয়ে এটিকে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সংযুক্ত করে বাজার ভিত্তিক করার জন্য। তাদের পরামর্শ অনুসারে জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্যের ওপর সরকার নির্ধারিত রাজস্ব হিসাব করে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। আর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়া কমার সাথে অভ্যন্তরীণ মূল্য বাড়বে বা কমবে। সরকার আইএএমএফের এই সংস্কার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে পুরনো মূল্য নির্ধারণী ব্যবস্থা অনুসারে জ্বালানি তেলের দাম ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে।

যুুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও জ্বালানি তেলের ওপর সরকার ১০ শতাংশ কর নেয়। বাংলাদেশে এই করভার পড়ে সাড়ে ৩২ শতাংশ। আর এভাবে জ্বালানি তেলতে রাজস্ব আদায়ের একতরফা হাতিয়ার করার মাধ্যমে ২০১৮ সাল থেকে শুল্ক কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকার ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকার রাজস্ব নিয়েছে এই খাত থেকে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এর বাইরে বিপিসি নিট মুনাফা করেছে ৪৮ হাজার ১২২ কোটি টাকা। এখান থেকে সংস্থাটি ৩১ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা ব্যাংকে ফিক্স ডিপোজিট করেছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *