কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল থামাতে না পারলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনায় মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছে। ইতোমধ্যে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন— যারা নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর ঝটিকা মিছিল-সমাবেশ থামাতে পারবে না, তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে কয়েকজন ওসিসহ বেশ কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এতে করে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে অনেকেই বলেন, হঠাৎ করে কয়েকজন মিলে ব্যাগ থেকে ব্যানার বের করে দু-তিন মিনিটের একটি মিছিল করে স্লোগান দেয়। আর এটার ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়। ফলে আগাম তথ্য না থাকলে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন ঝটিকা মিছিল করছে। হঠাৎ করে কয়েক ডজন বা কয়েকশত নেতাকর্মী কোনও এলাকায় উপস্থিত হয়ে স্বল্প সময়ে মিছিল বের করে স্লোগান দিয়ে দ্রুত সটকে পড়েন। কোনও কোনও মিছিল থেকে ককটেল-বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। বেশ কিছু জায়গায় অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। এ অবস্থায় এসব মিছিল ঠেকাতে মাঠ পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
গত সপ্তাহে ডিএমপির ৫০টির থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘‘যে থানা এলাকায় ঝটিকা মিছিল হবে, সেই থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) থেকে শুরু করে পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা জবাবদিহির আওতায় আসবেন। দায়িত্বে গাফিলতি প্রমাণ হলে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ তিনি বলেন, “দায়িত্বে অবহেলা বা শিথিলতার কারণে আর কেউ ছাড় পাবেন না।”
এই নির্দেশনার পর রাজধানীর শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও এবং হাজারীবাগ থানা এলাকায় আওয়ামী লীগের একাধিক ঝটিকা মিছিলের ঘটনা ঘটেছে। আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর, ৬০ ফিট ও শ্যামলীতে ঝটিকা মিছিলের ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানার একাধিক পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গত শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) মোহাম্মদপুর থানার একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারসহ (এসি) তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। শ্যামলীতে ঝটিকা মিছিল থেকে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে।
ডিএমপি সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাজহার আনামের নেতৃত্বে বাড্ডা-রামপুরা প্রধান সড়কে প্রথম ঝটিকা মিছিল হয়। এরপর কয়েক দিনের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, ধানমন্ডি, তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও উত্তরা এলাকায় একাধিক ঝটিকা মিছিল হয়। এর মধ্যে গত ৫ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে সবচেয়ে বড় মিছিল করে আওয়ামী লীগ। এর দুই দিন পর সংসদ ভবন অ্যাভিনিউতে আরেকটি বড় মিছিল করেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ এই রাজনৈতিক দলটির নেতাকর্মীরা।
অভিযোগ রয়েছে, গত ৭ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও থানা এলাকায় হওয়া মিছিলটি সম্পর্কে আগে থেকেই স্থানীয় পুলিশ জানতো। তবু আগাম কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ঝটিকা মিছিল থেকে গ্রেফতার ও অভিযান
চলতি বছরের জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব ঝটিকা মিছিলে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ২৬৯ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে জুলাইয়ে ৯ জন, আগস্টে ১১৬ জন এবং সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ১৪৪ জন গ্রেফতার হয়েছেন।
কেন বাড়ছে ঝটিকা মিছিল?
ডিএমপির একটি সূত্র জানায়, থানার কর্মকর্তাদের গা-ছাড়া মনোভাবের কারণেই কমিশনার ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে উঠে আসে—ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ভেতরে অনৈক্য বাড়ায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটি সুযোগ নিচ্ছে। ঝটিকা মিছিলে অংশ নেওয়া অনেকেই ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে অংশ নিচ্ছেন।
পুলিশের ভেতরে আতঙ্ক ও ক্ষোভ
কয়েকটি থানার কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, কমিশনারের বার্তার পর পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলেন, “পাঁচ থেকে ১০ জন মিলে হঠাৎ কোনও সড়কে বা গলিতে কয়েক সেকেন্ডের মিছিল করলে পুলিশ পৌঁছানোর আগেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ফলে তাৎক্ষণিক কিছু করা যায় না। পরে ছবি ও ভিডিও দেখে গ্রেফতার করা হয়।”
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এক এলাকার লোক অন্য এলাকায় মিছিল করছে—তাই শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তারপরও মিছিল ঠেকাতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।
রমনা থানার ওসি গোলাম ফারুক বলেন, “ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশনাকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। এটি শুধু থানার ওসি বা পরিদর্শকদের বিষয় নয়, বরং থানার প্রতিটি পুলিশ সদস্য এখন সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নজরদারি—সব কিছুই আমরা আরও শক্তিশালী করেছি।”
তেজগাঁও থানার ওসি মো. মোবারক হোসেন বলেন, “কমিশনার স্যারের নির্দেশনার পর আমরা আরও সতর্ক হয়েছি। মনে করছি, এতে দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব আরও বাড়বে। তারপরও যদি কেউ দায়িত্বে অবহেলা করেন, তাহলে তাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে থানার সব কর্মকর্তাকে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করছি।”
ধানমন্ডি থানার ওসি ক্যশৈন্যু মারমা বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনও নির্দেশনা পাইনি। তবে যেকোনও ধরনের অস্থিতিশীলতা ঠেকাতে পুলিশ সদস্যরা সব সময় প্রস্তুত থাকে। প্রয়োজনে নির্দেশনা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নেবো।”
উত্তরা পূর্ব থানার ওসি মো. গোলাম মোস্তাফা বলেন, “কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে আমরা সর্বোচ্চভাবে কাজ করে যাচ্ছি। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ধরনের কার্যক্রম ঠেকাতে আমাদের থানার প্রত্যেক পুলিশ সদস্য মাঠে রয়েছেন।”
পুলিশ বলছে, ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে তাদের সর্বোচ্চ তৎপরতা চলছে। ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেফতার করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিটি থানায় পেট্রোলিং, গোয়েন্দা নজরদারি ও চেকপোস্ট জোরদারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ ৩০-৪০ জনের ছোট দল ব্যানার নিয়ে মিছিল শুরু করে। এতে শুরুতে নিয়ন্ত্রণ কঠিন হলেও পরে সিসিটিভি ফুটেজ ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
ডিএমপি কমিশনার যা বলেছেন
শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘‘রাজধানীতে যেকোনও ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঠেকাতে পুলিশ সর্বোচ্চ প্রস্তুত রয়েছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে প্রতিটি থানার কর্মকর্তা গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। এ জন্য থানার ওসিসহ অফিসারদের কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’’ কোনও মিছিল বা বিশৃঙ্খলার আগে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং মিছিল থেকে ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
কমিশনার আরও বলেন, ‘‘টাকার বিনিময়ে এসব মিছিল করানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কাছে প্রচুর অর্থ রয়েছে। তারা জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে লোক ভাড়া করে মিছিলে নিয়ে আসছে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় গ্রেফতারকৃত একজন কো-অপারেটরও এ তথ্য স্বীকার করেছেন।’’ ডিএমপি কমিশনার বলেন, “তাদের হাতে তো অনেক টাকা আছে, সেই টাকা দিয়েই লোক ভাড়া করে এসব কাজ করাচ্ছে।” একইসঙ্গে এসব মিছিল ঠেকাতে সাধারণ জনগণকে সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি।
প্রধান সম্পাদকঃ সারওয়ার খান
সম্পাদকঃ জাকের খান (রুবেল)
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫