দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে এ বছর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যাও ২শ ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি আকার ধারণ করতে পারে- এমন শঙ্কা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
মঙ্গলবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব এস এম নাজিয়া সুলতানার মৃত্যু হয়েছে। সকালে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. হায়দার আলীর সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে।
এতে জানানো হয়, ৩০তম বিসিএসের মেধাবী এই কর্মকর্তা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত দুইদিন ধরে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মঙ্গলবার সকালে তিনি মারা যান।
বাংলাদেশে চলতি বছর ডেঙ্গু যে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে তা ২০১৯ সালে হয়ে যাওয়া মারাত্মক ডেঙ্গু পরিস্থিতির চেয়েও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বিবিসিকে বলেছেন, এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। এছাড়াও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু হাসপাতালে যাননি, এমন আরো কয়েক লাখ রোগী ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ওই সময়ে কেস রিপোর্ট ছিল এক লাখ, কিন্তু কেস ছিল ৮-১০ লাখের মতো। এবার একটা সম্ভাবনা আছে যে ওই সংখ্যাটাকেও ক্রস করে যায় কিনা।
অধ্যাপক আমিন বলেন, বিভিন্ন স্থানে ‘চেঞ্জ অব প্যাটার্ন অব দ্য ওয়ে লেংথে’ আমরা বিভিন্ন ধরণের রোগীর এক্সপ্লোশন (বিস্ফোরণ) দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে এ বছরটা তো সিরিয়াস ইস্যু সারা পৃথিবীতে । তিনি বলেন, পরিস্থিতি মহামারি আকার ধারণ করতে পারে এমন শঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত ডেঙ্গু সম্পর্কিত দৈনিক তথ্যও অবশ্য একই আভাস দিচ্ছে। এই তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই মৃত্যুর সংখ্যা ২০১৯ সালকে ছুঁইছুঁই করছে। এরইমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২০১ জন। আর ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন।
রোগ কখন মহামারি হয়?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন রোগ মহামারি হওয়ার জন্য কয়েকটি অবস্থা বিবেচনায় নিতে হয়। এর মধ্যে কোন রোগ যখন স্বাভাবিকের চাইতে বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়, দু’একটি এলাকায় সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্বাস্থ্যবিভাগের উপর চাপ সৃষ্টি করে, তখন রোগতত্ত্বের ভাষায় তাকে মহামারি বলে।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর এর উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বিবিসিকে বলেছেন, সেই হিসেবে ডেঙ্গুটা একটা মহামারি হয়েছে। কিন্তু মহামারি বলতে যে হাজার হাজার লোক প্রতিদিন মারা যাচ্ছে বোঝায়, সে অবস্থা এখনো হয়নি।
এদিকে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যখন বলছেন, পরিস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য ‘জরুরি অবস্থায়’ পৌঁছেছে। ডেঙ্গু সমস্যার সমাধান না হলে রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি করবে। তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বা মশা নিধন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়; স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ চিকিৎসাসেবা দেওয়া।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০১ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ৪১৮ জন। যা একদিনে এ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ নিয়ে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েন ৩৭ হাজার ৬৮৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২২ হাজার ৩৪৯ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ১৫ হাজার ৩৩৯ জন।
জুনে যেখানে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, জুলাইয়ের ২৪ দিনেই সেই সংখ্যা বেড়ে সাড়ে ছয় গুণ হয়েছে। আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুও বেড়েছে। গত মাসে ৩৪ জনের মৃত্যু হলেও এ মাসে প্রাণ গেছে ১৫৪ জনের।
সিলেটে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৩শ’ ছাড়িয়েছে : সারাদেশের মতো সিলেটেও বাড়ছে ডেঙ্গুরোগী। চার জেলায় গতকাল আক্রান্তের সংখ্যা ৩শ’ ছাড়িয়েছে।
মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত সিলেট বিভাগে আরো ২৩ জন ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি মওসুমে (জানুয়ারী থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত) সিলেটে শনাক্ত হয়েছেন ৩১৩ ডেঙ্গুরোগী। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ১৮৩ জন, সুনামগঞ্জ ১৯ জন, হবিগঞ্জ ৯৬ জন ও মৌলভীবাজার জেলায় ১৫ জন রয়েছেন।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায় বেশ কয়েকজন গার্মেন্টসকর্মী অসুস্থ হয়ে ঢাকা থেকে নিজ এলাকায় এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা সবাই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। সিলেটের অনেক গ্রামেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এদের অধিকাংশ রাজধানী ফেরত।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম জানান, বর্তমানে নগরীর বিভিন্ন স্থানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় ডেঙ্গুর শঙ্কা বাড়ছে। এর মধ্যে নগরীর ৪, ৭, ১০, ২৫ ও ২৬ নং ওয়ার্ড এবং দক্ষিণ সুরমার বাস টার্মিনাল ও কদমতলী এলাকায় পাওয়া গেছে লার্ভা। গেল মাসে ১০টি স্থান থেকে ‘নমুনা’ সংগ্রহ করা হলে ২-৩টি স্থানে এডিস মশার লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখন ১০টি স্থানের নমুনা পরীক্ষা করলে ৫-৬ জায়গায় এডিসের লার্ভা সনাক্ত হচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে এডিস মশার বিস্তৃতি ঘটছে। তাই মানুষকে সচেতন করা না গেলে ডেঙ্গুর ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের’ শঙ্কা রয়েছে।
শেয়ার করুন