ডেঙ্গুর মরণকামড়

জাতীয়

ডেঙ্গুজ্বরে প্রাণ হারিয়েছে ৬০০-এর বেশি মানুষ। এডিস মশার মরণকামড়ে প্রিয়জন হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে অসংখ্য পরিবার। দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এ বছর। করোনার গভীর ক্ষত আবার উসকে দিচ্ছে ডেঙ্গু। এ বছর ডেঙ্গুতে কেন এত মৃত্যু- দেশজুড়ে উঠেছে এ প্রশ্ন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল এক দিনে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৩৫২ জন। দেশে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ২৭ হাজার ৬৯৪ জন, মারা গেছেন ৬১৮ জন। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এ রোগটি ‘ঢাকা ফিভার’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। ২০২২ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ ছিল। সে বছর দেশে মারা যায় ২৮১ জন। তখন এটাই ছিল সর্বোচ্চ প্রাণহানি। এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু খুব দ্রুত বাড়ছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১৮-তে। দেশে ইতোমধ্যে ডেঙ্গুরোগী মৃত্যুতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।

দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এবার ডেঙ্গুতে বেশি মৃত্যুর কারণ মনে হচ্ছে রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসছেন। ফলে হাসপাতালে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। তবে হাসপাতালগুলো মৃত্যুর প্রতিটি কারণ বিশ্লেষণ করলে বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়া যাবে। এখনো আমরা বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্য পাইনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কাজের চেয়ে কথা হচ্ছে বেশি। এজন্যই দিন দিন সারা দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে চিকিৎসাব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি থাকায় রোগীরা বেশি ঢাকামুখী হচ্ছেন। করোনার সময় প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ দেওয়ার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু তা বাস্তবায়ন দেখছি না।’

এই জনস্বাস্থ্যবিদ জেলা ও বিভাগের বড় বড় হাসপাতালকে আরও সক্ষম করে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক আগেই এসেছে। এটা এখন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে গত বছরের সঙ্গে এ বছরের মধ্যে ডেঙ্গুরোগী আসার ক্ষেত্রে কোনো বিরতি ছিল না। শীতকালেও আমরা রোগী পেয়েছি। এবার মৌসুম শুরু হওয়ার এক-দেড় মাস আগে থেকেই অনেক বেশি রোগী পাচ্ছি। ডেঙ্গু মোকাবিলায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা অনেকটা গতানুগতিক। সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।’

স্বনামখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে। প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রোগীর জটিলতা হওয়ার শঙ্কা বেশি থাকে। উপসর্গে পরিবর্তন আসায় রোগী অনেক সময় বুঝতে পারেন না ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। বুঝতে না পেরে কিংবা অবহেলায় রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসছেন। এতে মৃত্যু বাড়ছে। যেসব রোগী ক্যান্সার, কিডনি, লিভারের বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত তাদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে ডেঙ্গু।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (সংক্রামক রোগ) ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকটি কারণে ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছে। অনেক রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসেন। ততক্ষণে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। দ্বিতীয়, তৃতীয়বার আক্রান্ত হওয়ায় রোগীর পরিস্থিতি বেশি জটিল হচ্ছে। এটা মৃত্যুর আরেকটি কারণ। আগামী বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত রোগীর সংখ্যা আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ এ বছর ১ লাখ ২৭ হাজার মানুষ এর মধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন। এরা যদি দ্বিতীয়বার কিংবা তৃতীয়বার আক্রান্ত হন, তাহলে বিপদ আরও বাড়বে। রোগী কমাতে চাইলে মশা মারায় জোর দিতে হবে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গু ঠেকানো যাবে না।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *