তাল গাছের অভাবে হুমকির মুখে বাবুই পাখি

জাতীয়

একসময় গ্রামগঞ্জে, এমনকি শহরতলীতেও অনেক তালগাছ দেখা যেতো; সেসব তালগাছে ঝুলে থাকতো হাওয়ায় দোদুল্যমান বাবুই পাখির বাসা। একসাথে দশটি, বিশটি বাসা ঝুলে থাকতে দেখা যেতো তালগাছগুলোতে। কিন্তু এগুলো অতীতের চিত্র।

বর্তমানে না দেখা যায় তালগাছ, না দেখা যায় তালগাছে বাবুইর বাসা। শুধু তালগাছ নয়; নারকেল, সুপারিসহ নানা দীর্ঘকায় বৃক্ষেই বাসা তৈরি করে বাবুই পাখি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এসব গাছ কমে যাওয়ায় আবাসন নিয়ে চরম সংকট পড়েছে বাবুই পাখি। বাবুই পাখির বাসা তৈরির সাথে জড়িত এর প্রজনন প্রক্রিয়া। প্রজনন মৌসুমে নারী বাবুইকে আকৃষ্ট করতে একের পর এক বাসা তৈরি করে যায় পুরুষ বাবুই পাখি। সেসব বাসা দেখেই পুরুষ বাবুইর প্রতি আকৃষ্ট হয় নারী বাবুই পাখি। নিরাপদ আবাস নির্মাণ করার পরই একটি পুরুষ বাবুই নারী বাবুইর সাথে মিলিত হবার যোগ্য প্রমাণিত হয়। তার ডাকে কাছে আসে স্ত্রী বাবুই পাখি। তাদের বাসায় ডিম আসে বাচ্চা ফোটে।

একই সঙ্গে একটি পুরুষ বাবুই একাধিক সংসার গড়ে তাই এতো বাসা তৈরি করে। কিন্তু এখন প্রজনন মৌসুম আসলে পুরুষ বাবুইদের ধুঁকতে হয় বাসা তৈরি নিয়ে। প্রয়োজনমত নিরাপদ উঁচু গাছ না পাওয়ায় অনেক অনিরাপদ গাছে বাসা তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছে বাবুই। এতে করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাবুইর প্রজনন প্রক্রিয়া এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জায়গায় বাবুই পাখিকে বাসা তৈরি করতে দেখা গেছে কলা গাছে, সাধারণ ঝোপঝাড়ে। আবাসন সংকটের মাঝেও যখন এসব জায়গায় বাবুই বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে তা অনায়াসেই নিয়ে যাচ্ছেন হিংস্র কিছু মানুষ।যার ফলে চরম অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে এই সময়ের বাবুই পাখি। ঝুঁকি জেনেও অনেকটাই বাধ্য হয়েই যেন অনিরাপদ জায়গাতেও আবাস গড়ে তুলছে পাখিগুলো।

পরে নিমিষেই ঝড়ের কবলে কিংবা মানুষের হাতে মারা পড়ছে। বাবুই পাখির বাসা তৈরিকে একসময় স্বনির্ভরতার প্রতীক এবং নৈতিকতার শিক্ষা হিসেবে বিদ্যালয়ে পাঠদান করানো হলেও বর্তমানে বাস্তবে নিজেদের বাসা নিয়ে হুমকির মুখে বাবুই পাখি। নৈতিকতার পাঠদানকারী কিছু অনৈতিক মানুষের কারণেই নিদারুণভাবে ধ্বংসের পথে হাঁটছে এ প্রজন্মের বাবুই পাখি।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য এম এ তাহের জানান, বাবুই পাখি সাধারণত তিন ধরনের বাসা তৈরি করে। নিচের দিকে অনেক লম্বা সরু একটা রাস্তা থাকে, যে রাস্তা দিয়ে বাসার ভেতরে ঢোকে। এমন বাসা অনাগত ছানার জন্য নিরাপদ। আরেক ধরনের বাসার বেশিরভাগ অংশ খোলা থাক। এমন বাসা বানানোর পেছনের কারণ হচ্ছে, বাবুই পাখিটি এই বাসায় বিশ্রাম করে বা এখানে বসে আশেপাশে সতর্ক পাহারা বসায়। আরেকটি বিশেষ ধরনের বাসা বানায়, যার ভেতরে দুইটি অংশ থাকে। সে বাসায় সংসার ছানাসহ বিশ্রামের আলাদা জায়গা থাকে।

কিন্তু চিরচেনা সেই দৃশ্যের দেখা এখন আর তেমন মেলে না। কারণ উঁচু তাল, নারিকেল ও সুপারি গাছ কমে যাওয়ায় বাসা বুনার উপযুক্ত স্থান হারাচ্ছে ক্রমশ। অতি লোভে দামি গাছ লাগানোর জন্য গাছপালা কেটে ফেলছে। ফলে বিপদে পড়ছে বাবুই পাখিরা। বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখির প্রথম পছন্দ তাল গাছ। এরপর নারিকেল বা সুপারি গাছ। এই সব গাছের পাতার সাথে অন্য লতাপাতা মিশিয়ে তারা বাসা গড়ে। উপরে বাসা বানানোর কারণে সে নিরাপদে থাকতে পারে। তাল গাছ বা নারিকেল গাছের এতো উপরে থাকে সেখানে সাধারণ অন্য কোনো কিছুর নাগালের বাইরে থাকে।

তিনি জানান, অতি লোভে আমরা তাল গাছ কেটে অন্য গাছ লাগাচ্ছি। তার ওপর কিছু কুসংস্কার আছে। গ্রামের মানুষ মনে করে তাল গাছে ভূতে বাসা বাধে। আর সে ধারণা থেকেই বেশিরভাগ তাল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। জ্ঞানের অভাবে টাকার লোভে প্রকৃতি ধ্বংস করে চলেছি উন্নয়নের প্রতিযোগী হয়ে। তাদের এই অবস্থা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কী করছি আমরা তাদের সাথে! নির্লজ্জের মতো মাথা নিচু করে রইলাম। এতটা পাষাণ আমরা কী করে হলাম? একটি গাছ কেটে কয়টি গাছ লাগিয়েছি আমরা তা কি ভেবে দেখেছি কখনো? আমি প্রথম দেখলাম কলা গাছের ডালে এবং কাশবনে বাসা বানাতে আর কেউ দেখেছে কি না, আমার জানা নাই। কতোটা বিপন্নর কাতারে চলে যাচ্ছে বাবুইপাখি। প্রকৃতি না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে কীভাবে?

এ বিষয়ে পাখিবিদ এস আই সোহেল বলেন, এই পাখির বাংলা নাম : দেশি-বাবুই, ইংরেজি নাম : Baya Weaver, বৈজ্ঞানিক নাম Ploceus philippinus। সাধারণত মে থেকে আগস্টের মধ্যে বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। একটি পুরুষ পাখির একাধিক বাসা ও পরিবার থাকতে পারে। এরা সাধারণত ২ থেকে ৪টি ডিম দেয়। ডিম ফুটে ছানা বের হতে ১৪ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। মেয়ে পাখি একা ডিমে তা দেয়। একটি ছানা ১৪ থেকে ১৬ দিনে নিজের মতো চলার সক্ষমতা অর্জন করে। বাবুই পাখিদের খাদ্য তালিকায় আছে ঘাস-বীজ, খাদ্যশস্য ও পোকা-মাকড়। তিনি আরও জানান, বাবুই পাখি তাল, নারকেল, সুপারি, খেজুর ও বাবলা গাছে বাসা করে থাকে। তবে বাসা বাধার জন্য সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে তাল গাছ। কিন্তু প্রকৃতি উজাড় করে তাল গাছ কেটে তাদের আবাসন আমরা ইতোমধ্যে নষ্ট করে ফেলেছি।

বাংলাদেশ বার্ডক্লাবের সহ সভাপতি তারেক অণু জানান, একটা মূল কারণ হচ্ছে মানুষের ধারণা যে তাল গাছ লাগায় তার তিন প্রজন্ম পরেই সেই গাছে তাল হয় এই ধারণা থেকে মানুষ তাল গাছ লাগায় না। অথচ সত্যি কথা হচ্ছে মানুষ তার লাগানো গাছ থেকেই তাল খেতে পারে জীবদ্দশাতে. অতি লোভে আমরা তাল গাছ কেটে অন্য গাছ লাগাচ্ছি। তার ওপর কিছু কুসংস্কার আছে। গ্রামের মানুষ মনে করে তাল গাছে ভূতে বাসা বাধে। আর সে ধারণা থেকেই বেশিরভাগ তাল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। জ্ঞানের অভাবে টাকার লোভে প্রকৃতি ধ্বংস করে চলেছি উন্নয়নের প্রতিযোগী হয়ে। বাবুই পাখির জন্য আমাদের তাল গাছ রক্ষা করতে হবে। প্রকৃতির এই শিক্ষকে পরিবর্তী প্রজন্মের সামনে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *