তিন বছর মেয়াদের কমিটির সময় শেষ হতে চলছে। এর মধ্যে তৃণমূলকে ঢেলে সাজাতে পারেনি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ। নানা অজুহাতে ওয়ার্ড কমিটি পুনর্গঠনে হাত দেননি মহানগর শাখার দায়িত্বশীলরা। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের চাপে শীর্ষ নেতারা ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন তৃণমূলে।
তৃণমূলের ক্ষোভের আগুনে এখন পুড়ছে মহানগর আওয়ামী লীগ। তৃণমূলের অভিযোগ ওয়ার্ড কমিটি গঠনে কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কাই করছেন না মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন। নিজের আত্মীয়-স্বজন ও বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দিচ্ছেন নেতৃত্ব। এতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা বঞ্চিত হয়ে ক্ষুব্দ হয়ে ওঠেছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডের সম্মেলনে সংঘাত, সংঘর্ষ ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, আগামী সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ‘মাইম্যান’ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেছেন সাধারণ সম্পাদক। এতে দলের ‘বারোটা’ বাজাচ্ছেন তিনি।
২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সম্মেলনে মাসুক উদ্দিন আহমদকে সভাপতি ও জাকির হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন দিবস পালনেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম। সম্মেলনের আড়াই বছর পর কেন্দ্রের চাপে গত জুন থেকে ওয়ার্ড কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এরপর থেকেই তৃণমূল থেকে সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও পকেট কমিটি গঠনের অভিযোগ ওঠতে থাকে। ইতোমধ্যে মহানগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১২টিতে আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে তোপের মুখে পড়ে একটি ওয়ার্ডের কমিটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ১২টি ওয়ার্ডের সম্মেলনের মধ্যে তিনটিতে সংঘাত সংঘর্ষ হয়েছে। আর ৬টির নেতৃত্ব বিএনপি-জামায়াত পরিবার ও সাধারণ সম্পাদকের আত্মীয়-স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।
তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মহানগর সভাপতি এর আগে জেলার রাজনীতি করেছেন। মহানগরের রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ হওয়ায় প্রবীণ এই নেতাকে চাপে ফেলে ও ভুল বুঝিয়ে সাধারণ সম্পাদক একতরফাভাবে নিজের পছন্দের লোকজন দিয়ে কমিটি করছেন। ওয়ার্ড কমিটির জন্য গঠিত সাবকমিটির সদস্যদেরও কোন মতামত নিচ্ছেন না তিনি। নেতাকর্মীরা বলছেন, সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়াটা জাকির হোসেনের কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতো ছিল। এরপর থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন পরবর্তী সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে। দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তিতে তৃণমূলের নেতাদের নিজের পক্ষে রাখতে ‘মাইম্যান’দের পদায়ন শুরু করেন তিনি। আর এতে দেখা দেয় ক্ষোভ-অসন্তোষ।
গত ১০ অক্টোবর ১৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলনে নেতাকর্মীরা ভোটের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের দাবি তুলেন। কিন্তু মহানগরের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন নিজের পছন্দের লোকজনের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে এতে অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে তিনি তার মামাতো বোনের জামাই সাজুয়ান আহমদকে সভাপতি ও তার আস্থাভাজন শফিকুল ইসলাম আলকাছকে সাধারণ সম্পাদক ও আবদুল মুকিতকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা দেন। কাউন্সিলে আলকাছ প্রার্থীই ছিলেন না। একপর্যায়ে সম্মেলনস্থলে সংঘর্ষ শুরু হলে পালিয়ে যান জাকির হোসেন। আর পরিস্থিতি সামাল দিতে কমিটি স্থগিত ঘোষণা দেন সভাপতি মাসুক।
১৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব খান মাছুম বলেন, ‘মেয়র পদে প্রার্থী হতে দল নিয়ে খেলছেন জাকির হোসেন। তিনি দলের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মাইম্যান তৈরি করছেন। নিজের আত্মীয়-স্বজন ও আজ্ঞাবহ মানুষ দিয়ে পকেট কমিটি করছেন।’
গত ১৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলন। ওই সম্মেলনেও তৃণমূলের নেতাকর্মী ও প্রার্থীরা ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের দাবি তুলেন। কিন্তু তাদের দাবি উপেক্ষা করে অধ্যাপক জাকির নিজের পছন্দের লোকের নাম সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষনা দেন। ওই ওয়ার্ডে সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন সাবেক সহ সভাপতি আতিকুর রব চৌধুরী জুয়েল।
তিনি বলেন, ‘একটি কক্ষের মধ্যে আমাদেরকে জিম্মি করে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। ঘোষিত কমিটি না মানলে বহিস্কারেরও হুমকি দিয়েছেন জাকির হোসেন। পরে কমিটিতে জাকির হোসেন তার ভাগ্না জাহিদুল হোসেন মাসুদকে সাধারণ সম্পাদক করেন। জাহিদের ভাই শহিদুল হোসেন মামুন ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য। তার আরেক ভাই জামায়াত করেন। ২১নং ওয়ার্ডেও জাকির যাকে সাধারণ সম্পাদক করেছেন, তার আপন ভাই ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি।’ জুয়েল আরও বলেন, ‘জাকির যেভাবে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছেন। এ থেকে দলকে মুক্ত করা না গেলে সিলেট আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে যাবে।’
গত ৪ সেপ্টেম্বর ২৫নং ওয়ার্ড শাখার সম্মেলন করতে গিয়ে নিজের পছন্দের লোকজনের নাম ঘোষণা করতে না পেরে পালিয়ে আসেন নেতারা। এসময় সম্মেলনস্থলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে প্রেসরিলিজ ইস্যু করে কমিটি ঘোষণা করা হয়।
২৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ও সিটি কাউন্সিলর তাকবিরুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ‘সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অবৈধভাবে ওয়ার্ড কমিটি দিয়েছেন। এই কমিটি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা প্রত্যাখান করেছেন। দল শক্তিশালী করতে এসে সাধারণ সম্পাদক আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছেন।’
কমিটি গঠন নিয়ে অসন্তোষের প্রেক্ষিতে মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বিজিত চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বক্তৃতায় ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের মূল্যায়নের কথা বলি। কিন্তু কমিটি গঠনের সময় খুঁজি পকেটের মানুষ। এজন্যই বিভিন্ন ওয়ার্ডে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে। কমিটিতে ত্যাগী ও পরীক্ষিতরা বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ অসত্য নয়।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন- ‘১২টি ওয়ার্ড কমিটির মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে একটি স্থগিত করতে হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক জাকিরের বিরুদ্ধে নিজের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনদের পদ দেওয়ার অভিযোগ অনেকে করছেন। কিন্তু এই অভিযোগ সময়মতো কেউ করছেন না। তবে এসব ব্যাপারে সাধারণ সম্পাদককেও আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।’
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনকে দুইদিন বেশ কয়েকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
শেয়ার করুন