গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ। বাইরে বেরোলেই যেনো প্রাণ সংহারের ভয়। চলমান প্রচন্ড দাবদাহে এমন অবস্থা সিলেটে। প্রকৃতিতে তাপ প্রবাহ বাড়ার কারণে সিলেটে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে জনজীবন। এর প্রভাবে বাড়ছে রোগ বালাই। বিশেষ করে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
টানা কয়েকদিন ধরে ৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গড় তাপমাত্রা। ফলে শিশুরা অসুস্থ হচ্ছে বেশি। অসহনীয় এই গরমে শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট ডায়রিয়া, সর্দি-জ্বর, হিটস্ট্রোক ও পানিশূন্যতা জনিত সমস্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। যারফলে সিলেটের প্রধান হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে বেড সঙ্কট, বাড়ছে অভিভাবকদের হতাশা।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিলেট শিশু হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে শিশু রোগীদের ভিড় বেড়েছে কয়েকগুণ। শিশু ওয়ার্ডে জায়গা না থাকায় অনেক শিশুকে মেঝেতে শোয়াতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা। একটি বেডে একাধিক শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, যা থেকে সহজেই বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন শিশু রোগী ভর্তি হচ্ছে, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী।
চিকিৎসকরা বলছেন, এই বয়সী শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব তাদের ওপর দ্রুত পড়ে।
হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, একটি বেডে দুই থেকে তিনজন শিশু রোগী রাখা হয়েছে। অনেককে শিশু রোগিকে নিয়ে মেঝেতে বিছানা পেতে রয়েছেন। পর্যাপ্ত ফ্যান নেই, নেই কোনো এয়ার কুলিং ব্যবস্থা। ফলে রোগীদের কষ্ট দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। প্রচ- গরমে শিশুরা অস্থির হয়ে উঠছে, কখনও কাঁদছে, আবার কখনও নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।
অন্যদিকে, সিলেট শিশু হাসপাতালেও একই চিত্র। শিশুরা ডায়রিয়া, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে হিট র্যাশ, বমি ও গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের মতো সমস্যাও দেখা দিচ্ছে।
হাসপাতালের ২১ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের চিকিৎসক ডা. রাফে বলেন, ‘এই সময়ে হঠাৎ এত রোগীর চাপ বাড়ায় আমাদের প্রচ- সঙ্কটে পড়তে হচ্ছে। ওয়ার্ডে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই, ফ্যান পর্যাপ্ত থাকলেও রোগীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ফ্যানের গরম বাতাস বইছে। শিশুদের ঘেমে যাওয়ার ফলে অনেক সময় শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে। যারা ডায়রিয়া বা জ্বরে ভুগছে, তাদের জন্য গরমটা আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।’
২২ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের অন্য এক চিকিৎসক জানান, ‘এই গরমে শিশুরা খুব দ্রুত পানিশূন্যতায় ভোগে। হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের অনেক রোগীকে স্যালাইন দিয়ে রাখতেই হচ্ছে। কিন্তু এত রোগীর চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক নার্স বলেন, ‘গরমে শিশুরা কান্নাকাটি করছে, মায়েরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। ৩/৪টি ফ্যান ঘুরছে পুরো ঘরে, তাও আবার ঠিকমতো চলে না। অনেক সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। অভাব শুধু বেডের না, শীতলীকরণ ব্যবস্থারও তীব্র ঘাটতি রয়েছে। রোগীদের পাশাপাশি আমরা চিকিৎসারাও প্রচ- গরমে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছি।’
সাইফুল ইসলাম নামের অভিভাবক তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘আমার মেয়ে ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছি। ওয়ার্ডের ভেতরে কোনো বাতাস আদান-প্রদানের কোনো রাস্থা নেই। এখানে এক একটি ওয়ার্ডে ৩২-৪০টিফ্যান থাকলেও ভেতরে থাকা ফ্যানের বাতাস বইছে গরম আগুনের হুলকার মতো। এতে বাচ্চার অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এই গরমে হাসপাতালে থাকা অনেক কষ্টকর।’
ইনাত মিয়া নামের অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার ছেলেটার জ্বর আর ডায়রিয়া, হাসপাতালে নিয়ে এসেছি কিন্তু এখানে গরমে আরও খারাপ অবস্থা। এই ওয়ার্ডগুলোতে বাতাস কুলিংয়ের কোনো পদ্ধতি নেই। ভেতরে বাতাস বাইরে বের করে দেওয়ারও কোনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই।
চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন, গরমের মধ্যে শিশুকে রোদে বের না করা, ঘন ঘন পানি পান করানো ও ঠান্ডা ঘরে রাখার ব্যবস্থা করাই এখন প্রধান করণীয়। এই সময়ে শিশুদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পানি ও তরল খাবার খাওয়াতে হবে। সম্ভব হলে ঘর শীতল রাখার চেষ্টা করতে হবে। বাচ্চাদের রোদে বের না করা, হালকা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী তিন থেকে চারদিন এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টি না হওয়ায় গরমের তীব্রতা বাড়ছে, যা শিশুদের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি না হওয়ায় গরমের তীব্রতা কমার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এই চরম আবহাওয়ায় হাসপাতালগুলোর অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব শিশুদের জীবনের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ না হলে সামনে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
শেয়ার করুন