দিশেহারা মানুষ খুঁজছে জীবনযুদ্ধের পুঁজি, মাথা গোঁজার ঠাঁই

সিলেট

সিলেটে নদ-নদীর পানি কমতে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির সুখবর মিললেও সংকট পৌঁছেছে চরমে। পানি কমায় জেগে উঠছে প্লাবিত এলাকা। প্রতিদিনই বাড়ছে বন্যা পরবর্তী দুর্ভোগ।তীব্র হচ্ছে খাবার ও সুপেয় পানির সংকট। ছড়াচ্ছে পানিবাহিত নানা রোগ।আছে সহায় সম্বলহারা মানুষের বুকফাঁটা আর্তনাদ, হাহাকার।

বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরা এখনো বহুদূর। এখনো পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ। ঘর হারিয়ে বহু মানুষের ঠাঁই মিলেছে সড়কে।কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের বাড়িতে।গৃহহীন মানুষগুলো চরম অসহায়।তাঁরা মাথা গোঁজার ঠাঁই খুজছেন।

আশ্রয়কেন্দ্র থেকে দুই লাখের বেশি মানুষ বিধ্বস্ত বসতভিটায় ফিরে গেলেও, প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এখনো বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে  ৯৯ হাজার ৭৫৮টি ঘরবাড়ি। গোলার ধান পানিতে ডুবে অঙ্কুরিত হয়ে গেছে। দিশেহারা মানুষগুলো এখন খুঁজছে জীবনযুদ্ধের পুঁজি।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের চার জেলায় স্মরকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৬৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৬৫ জন মানুষ।আর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৬ লাখ ২২ হাজার ৯৬৮টি।

সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জের প্রায় ৩০ লাখ লোকজন। সিলেট জেলা ও মহানগরীতে ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩৩ জন, মৌলভীবাজারে ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৩৬ এবং হবিগঞ্জে ৮৩ হাজার ৪৯০ জন।একইভাবে সিলেট বিভাগের সে চেয়ে বেশি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়। এ জেলায় বন্যায় ৪৫হাজার বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭টি এবং আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৪০ হাজার ৫৪১টি বসতঘর।ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে সিলেট জেলা। এ জেলায় ৪০ হাজার ৯১টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া মৌলভীবাজার জেলায় ১৪ হাজার ৩০৯টি ও হবিগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭০টি বসতঘর।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবুর রহমান জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত ও গৃহনির্মাণের জন্য জেলার পাঁচ হাজার পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া মিলেছে।সোমবার (৪ জুলাই) থেকে অনুদানের এই অর্থ বিতরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তালিকাভূক্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত সিলেট জেলায় তিন কোটি টাকার বেশি নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণকৃত অর্থের মধ্যে সরকারিভাবে প্রাপ্ত ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে শিশুখাদ্যের জন্য ১০ লাখ টাকা, গো-খাদ্যের জন্য ১০ লাখ টাকা রয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ৬১২ মেট্রিক টন চাল ও ২০ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্তদের বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য সরকারিভাবে যা যা করণীয় সব কিছুই করা হবে।পুরো পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে।

এদিকে আজ বুধবার থেকে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হওয়ার আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এ আভাস দিয়ে কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, সব নদ-নদীর পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

কুশিয়ারা ব্যতীত, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব প্রধান নদ-নদীসমূহের পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীসমূহের পানির সমতলও বৃহস্পতিবার হ্রাস পেতে পারে।পাউবো জানিয়েছে, তাদের পর্যবেক্ষণাধীন বিভিন্ন নদ-নদীর ১০৯টি পয়েন্টের মধ্যে মঙ্গলবার পানির সমতল বেড়েছে ৪২টিতে, কমেছে ৬৫ টিতে, অপরিবর্তিত আছে দুটি পয়েন্টের পানির সমতল।

বর্তমানে তিন নদীর পানি চারটি পয়েন্টের বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমার পানি কানাইঘাটে বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, কুশিয়ারার পানি অমলশীদে ৭৯ সেন্টিমিটার ও শেওলায় ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

‘৮০ ভাগ মানুষ এখনো পানিবন্দি’

বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি সাইদুল ইসলাম জানান, বিয়ানীবাজার উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও কুড়ার বাজার ইউনিয়নের খশির চাতল পার এলাকার ৮০ ভাগ বাড়ি এখনো পারি নিচে। গ্রামের প্রধান সড়ক থেকে এখনো বন্যার পানি না নামায় নৌকা দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে এই এলাকার বাসিন্দাদের।

কথা হয় একই গ্রামের আয়ফলা বেগম (৬০) এর সাথে তিনি বলেন, ‘পয়লা পানি আওয়ার সময় আমার ঘরও কমর পানি আছিল। এখনো আটু পানি আছে। পরিবার লইয়া আশ্রয় কেন্দ্রত আছি। দিনও বাড়ি থাকি রাইত আশ্রয় কেন্দ্র যাই গি। ঘরর অবস্থা নাই পানি এ সবতা নষ্ট করি দিছে। দিনও ঘরও আইলে কান্দন আয় আমার। এখন পানি আছে এর লাগি ঘর খাড়া আছে। পানি হরি গেলে গি ঘর পড়ি যাইবো। ইবার খেত করিয়া কিছু ধান পাইছলাম আমরা পানি ডুবিয়া সব নষ্ট ওই গেছে। ১০ জন ওর পরিবারও আমার জামাই একমাত্র রুজগারি। তাইনও বেকামা এখন। রুজওর কাম করতা এখন রুজর কামও নাই। কিতা যে সামনর দিনও আমরার কপালো আছে জানি না বাবা। ইতা চিন্তা করলে চকুর পানি আটকাইতাম পারি না। ’

একই গ্রামের সইজ্জাদ আলীর (৭৫) বাড়িতে দেখা গেল কোমর পানি।পানিবন্দি সইজ্জাদ আলীর ৮ সদস্যর পরিবার নিয়ে দিন ভালো কাটছিল।  কিন্তু বন্যার কারণে সব কিছু হারিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব।

কান্না জরিত কণ্ঠে নিজের ঘরের দুরবস্থা দেখিয়ে বৃদ্ধ সইজ্জাদ আলী বলেন, ‘চিন্তায় কিচ্চু ভালা লাগের না। তিন পুয়া রুজগারি আছলা এখন তারাও বেকামা ওই গেছন। ইবার’র পানি আমারে রাস্তাত নামাই দিব। এক টেখাও নাই হাতও এলাকার মানুষে ত্রাণ দেওয়ায় খাইয়া বাছিয়া আছি। পানি নামার বাদে ঘর টিক করইতাম না পরিবার লাইয়া খাইয়া বাচতাম জানি না। প্রত্যক দিন আইয়া আমার মায়ার বাড়ি খান দেখি। বাড়ির ই অবস্থা দেখিয়া চকুর পানি দরিয়া রাখতাম পারি না। দিনও ৫-৬ বার বুক পানি মারিয়া আইয়া বাড়ি খান দেখি টিন-টান আছে নি, না পানি এ ভাসাইয়া লইয়া গেছে গি। কত আরামে আমার বাড়িত আছলাম এখন থাকিয়ার পরর বাড়ি। জান বাচানির লাগি গাউর এক চাচার ঘরও ভাইর বাড়ি উঠছি পরিবার লইয়া। নিজর ঘর-বাড়ি ছাড়া রাইত ঘুম উ লাগে না। ঘরর মাল পত্র এখনো সবতা পানিত ভাইয়া ফিরের। কিচ্চু বাচাইতাম পারছি না। শখ করি গতবার ফ্রিজ লইছলাম, ফ্রিজর ভিতরে পানি হামাইয়া নষ্ট ওই গেছে। এখান বেট (বিছানা) কোনমতে মাতাত করি লইয়া গেছলাম আর কিচ্চু নিতাম পারছি না সবতা ঘরর ভিতরে রইছে। আমি জীবনে ইলান বিপদও পড়ছি না ইবার যেলা বিপদও আছি।’

নৌকা নিয়ে এগোতে নিজ ঘর থেকে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করলে একই গ্রামের হাফছা বেগম (৫০)। তিনি বলেন, ‘আমার ঘর থাকি পানি নামছে আইজ ৩ দিন। পানি নামার বাদে দেখি ঘরর সব মাঠি দইয়া নিছে গি। ঘরও আটু (হাঁটু) পেক (কাদা)। ই ঘর এখন আর থাকা যাইত নায়। পয়েলা ঘরও মাঠি ভরানি লাগবো। পানির ঢেউয়ে টিন বাজরা থাকি খুলি খুলি গেছে গি। ইতা টিক করানিত গেলে উ ৩০-৪০ হাজার টেখা লাগবো। অত টেখা কই পাইতাম। কে দিব ওত টেখা। হুনিয়ার সরকার থাকি ঘর টিক করি দিবা’র লাগি টেখা দিবা। আইড়ি কার্ড আর আমার ফটো নিছইন। জানি না পাইমু কি না।’

কুড়ার বাজার ইউনিয়নের ১০ নং ওয়ার্ডের সদস্য ও একই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মালিক বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের মধ্যে আমার ওয়ার্ডের ৮০ ভাগ মানুষ এখনো পানিবন্দি। আমার ওয়ার্ডে কিছুটা নিম্নাঞ্চল তাই এখনো বন্যার পানি নামে নি। আমার এলাকার মানুষের দুঃখ দুর্দশার শেষ নেই। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করছি।’

বন্যা কেড়ে নিল মাথা গোঁজার ঠাঁইও

ছাতক থেকে স্টাফ রিপোর্টার রেজাউল করিম রেজা জানান, মাত্র দেড় মাস আগের প্রথম দফা বন্যায় বর্গা চাষের বোরো ধান ঘরে তুলতে পারেননি, মাঠেই ধান নষ্ট হয়ে যায় আবদুর রউফের। ফসল হারানোর কষ্ট লাঘব হতে না হতেই এবারের প্রবল বন্যায় শেষ সম্বল ভিটেমাটি ভেসে গেছে।

বন্যায় সব হারিয়ে দিশেহারা সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের কাটা চানপুর গ্রামের আবদুর রউফ বলছিলেন ভয়ঙ্কর সেই রাতের কথা।

তিনি বলেন, ‘সেদিন (১২ জুন) সন্ধ্যা থেকে দ্রুত পানি বাড়ছিল। পানি বাড়তে থাকায় একপর্যায়ে দুটি খাট একসঙ্গে করে এর ওপরে পাঁচ ছেলেমেয়েকে তুলে দিয়ে কোমরসমান পানিতে স্ত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নাম জপছিলাম আর চিৎকার করছিলাম সাহায্যের আশায়।’

সব আশা যখন শেষ, যখন ঘরের ভেতর বুকসমান পানি, তখন ছোট নৌকায় করে এক ব্যক্তি তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যান পার্শ্ববর্তী গ্রামের সোনাহর আলীর বাড়িতে।

আবদুর রউফ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘নৌকায় ওঠার অল্প সময় পর চোখের সামনে দিয়ে বন্যার পানিতে ভেসে যায় বছরের পর বছর কাজ করে জমানো টাকায় বানানো কষ্টের ভিটেমাটি। এক নিমিষেই ফতুর হয়ে গেলাম।’

মাত্র দেড় মাস আগের কথা। বর্গা নিয়ে চাষ করা অল্প কিছু জমির বোরো ধান তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আবদুর রউফ। তবে ঘরে তুলতে পারেননি ফসল। সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এবারের বন্যায় সব হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকাই এখন কষ্টকর, তাই ঈদের আনন্দ নেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে। যার ঘর নেই, বাড়ি নেই, খাওয়ার উপায় নেই তার আবার ঈদ কিসের!’ তিন মেয়ে ও দুই ছেলে এবং স্ত্রী শরিফা খাতুনকে নিয়েই আবদুর রউফের সংসার। তিনি এখন সকাল হলেই ত্রাণের আশায় রাস্তায় বসে থাকেন। গাড়ি দেখলেই ত্রাণের জন্য দৌড়ান।

পরিবারের সবার কাপড়চোপড়সহ যা কিছু ছিল সব বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে এক কাপড়ে নৌকায় করে এসেছিলেন। মেয়েদের জন্য স্ত্রী শরিফা গ্রামের মহিলাদের কাছ থেকে অল্প কিছু পুরাতন জামাকাপড় এনেছেন যা পর্যাপ্ত নয়।

আবদুর রউফ জানান, সোনাহর আলীর বাড়িতে কদিন থাকতে পারবেন তা জানেন না। কাজের আশায় প্রতিদিন ঘর থেকে বের হন, কিন্তু চারদিকে এখনো পানি। কোথাও কাজ নেই। বড় মেয়ে সারজেনার বিয়ের কথা চলছিল। এখন পানি হয়তোবা চলে যাবে কিন্তু মেয়ের বিয়ে দেওয়ার খরচ পাবেন কোথায়, ঘর বানানোর টাকাই বা দেবেন কে- এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে তার মনে।
বানের পানিতে তলিয়ে নিঃস্ব আজিদুন নেছারা

তাহিরপুর প্রতিনিধি আলম সাব্বির জানান, হাওরবেষ্টিত ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের দুধের আউটা গ্রামের মৃত আব্দুল জলিলের স্ত্রী আজিদুন নেছা (৭০)। প্রায় দেড় যুগ আগে স্বামী আবদুল জলিল হঠাৎ মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। দুই মেয়ে নিয়ে পড়েন চরম দুর্ভোগে। আনেক কষ্টে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে হয়ে যান নিঃস্ব। আজিদুন নেছা পেটের দায়ে ছুটে যান রাজধানী ঢাকার মিরপুরে। গৃহপরিচারিকার কাজ করতে। সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার খবর শুনে বাড়ি চলে আসেন। বাড়ি এসে দেখেন মাথা গোঁজার একটা ঘর ছিল সেটাও বানের জলে ভেসে গেছে।

কথা হয় বৃদ্ধা এ নারীর সঙ্গে। একমাত্র বসতঘর হারিয়ে এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে  বলেন ‘চেয়ারম্যানরে কইলাম, মেম্বাররে কইলাম, কেউ আমারে একটা ঘর দিল না। আপনাদের তো চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সঙ্গে পরিচয় আছে, আপনাদের মাধ্যমে কতজন কত কিছু পাইছে। আমার একটা ঘর নাই, বানের পানিতে আমার ঘর গেছে। আমারে একটা ঘর পাওয়াইয়া (পাইয়ে) দেন না। আমারে কী একটা ঘর দিব সরকার? আমারে একটা ঘর দিলে আমি শেখ হাসিনার জন্য আজীবন নামাজ পড়ে দোয়া করতাম।’

তিনি  বলেন, ‘দুনিয়ায় আমার মতো অভাগিনি মনে হয় আর কেউ নেই। বার্ধক্যজনিত চিকিৎসা আর পেটের ক্ষুধা মেটাতে মানুষের সাহায্য নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি। আর কোনো পথ নেই।

তবুও যদি শেখ হাসিনা একটা ঘর দিতেন, অন্তত বাকি জীবটা আমি একটু শান্তিতে থাকতে পারতাম। আমারে একটা ঘর দিলে আমি শেখ হাসিনার জন্য সারাজীবন নামাজ পড়ে দোয়া করতাম।’

শুধু তাহিরপুরের আজিদুন নেছাই নন- এবারের বন্যায় সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, ধরমপাশা, মধ্যনগর, ছাতক, জগন্নাথপুর, দোয়ারাবাজারসহ ১২টি উপজেলার ৪৫ হাজারের উপরে বাড়িঘর পানির তোড়ে ও আফালের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবারের মাঝে ঈদের আনন্দের বদলে বইছে শোকের মাতম।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ধরমপাশা উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন রয়েছে। ১৬ জুন বন্যার পানি বাড়িঘরে ঢুকে পড়ে। বসতঘর, রান্নাঘর ও গোয়ালঘরের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ায় ১৭ জুন সকালে বন্যার্ত মানুষজন গবাদিপশু নিয়ে আশপাশের উঁচু বাড়ি ও পাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আশ্রয় নেন। বন্যায় জমিয়ে রাখা গো-খাদ্য (খড়) ও অনেকের বসতঘরের ভেতরে থাকা ধান, চাল ও বিভিন্ন মালামাল পানিতে ভেসে যায়।

সেলবরষ ইউনিয়নের গাবী গ্রামের কৃষক আজিজুল হক জানান, মানুষের জন্য সরকার ত্রাণসামগ্রী দিলেও এখন পর্যন্ত তারা গো-খাদ্য বাবদ কোনো রকম সহায়তা পাননি। গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দেয়ায় তাদের অনেককেই নিরুপায় হয়ে হাটে গরু, ছাগল এনে কম দামে বিক্রি করছেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনতাসির হাসান জানান, গো-খাদ্যের জন্য সরকারি কিছু অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেছে। তা দিয়ে গো-খাদ্য ক্রয় করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জে গত ১৬ জুন স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যায় জেলার রাস্তাঘাট, পুকুরের মাছ, গোলায় রাখা ধান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় জেলার ১১টি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভায় ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘরের সংখ্যা ৪৫ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭টি। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৪০ হাজার ৫৪১টির। এর ফলে গৃহহীন হয়েছেন জেলার কমপক্ষে আড়াই লাখ মানুষ। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় জেলায় ২৫ হাজার ২০৪টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। মারা গেছে ১ হাজার ৬৪২টি গবাদিপশু । এর মধ্যে গরু ৪২২টি, মহিষ ৩৭টি, ছাগল ৬৬৯টি ও ভেড়া ৫১৪টি। এছাড়া বন্যায় ২৮ হাজার ৮০৫টি মুরগি ও ৯৭ হাজার ৮৩১টি হাঁস মারা গেছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা সবদিকে নজর রাখছি, খাবারের সংকট নেই, আমরা যেখানে যেভাবে প্রয়োজন সেভাবেই ত্রাণ সহায়তা পাঠাচ্ছি, আমাদের সাথে যৌথবাহিনীও কাজ করছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *