কুড়িগ্রাম রিভার ভিউ হাই স্কুলের শিক্ষক রাজু আহমেদ। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ২০২১ সালে এ প্রতিষ্ঠানে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে ২০২২ সালে এমপিওভুক্ত হন তিনি। এর আগে ২০১৮ সালে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার ইসলামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। সেখানে ২০১৯ সালে এমপিওভুক্ত হন (ইনডেক্স নম্বর-১১৫৫২৭৭)। রাজু আহমেদের বিরুদ্ধে দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই বেতন-ভাতা তোলার অভিযোগ রয়েছে।
ইএমআইএস (এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) সেল থেকে তথ্য যাচাই করে রাজু আহমেদের দুই প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন উত্তোলনের সত্যতাও মিলেছে। তবে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি তিনি। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে ফোন কেটে দেন।
‘খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে দ্বৈত এমপিও থাকা শিক্ষকদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে। এরপর তাদের বেতন-ভাতা বন্ধসহ পূর্বে গ্রহণ করা বেতন-ভাতা সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে। যারা রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করারও সুপারিশ করা হবে’— উপপরিচালক, মাউশি
শুধু রাজু আহমেদই নয়; বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত তিন হাজারের অধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে একসঙ্গে দুটি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি বেতন-ভাতা গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে প্রতি বছর সরকারের প্রায় শতকোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই তথ্যে বেশ কিছু শিক্ষক দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন বলে সামনে এসেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে কর্মরত শিক্ষকদের বেতন-ভাতার তথ্য চাওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা অনলাইনে তথ্য পাঠিয়েছেন। সেই তথ্য যাচাই করে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে মাউশির ইএমআইএস সেলে জমা হয়েছে।
ইএমআইএস সেলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আঞ্চলিক পরিচালকরা যে তথ্য যাচাই করে পাঠিয়েছেন, সেখানে তিন হাজারের বেশি শিক্ষকের দ্বৈত এমপিও থাকার বিষয়টি সামনে এসেছে। আইবাস সেলের মাধ্যমে তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা তাদের।
এ বিষয়ে মাউশির ইএমআইএস সেলের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট খন্দকার আজিজুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের তথ্য পাঠানোর সময়সীমা আজ বুধবার শেষ হচ্ছে। এই তথ্যগুলো আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আইবাস ++এ পাঠাবো। তারা একটি ভোটার আইডি কার্ডের মাধ্যমে কতজন এমপিওভুক্ত হয়েছেন সে তথ্য বের করে তালিকা চূড়ান্ত করবেন।’ কতজন শিক্ষক দুই প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন নিচ্ছেন তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন এ কর্মকর্তা।
‘ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই তথ্যে বেশ কিছু শিক্ষক দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন বলে সামনে এসেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে’— অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম, ডিজি, মাউশি
মাউশির আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৯ সালের পূর্বে এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে ভোটার আইডি কার্ডের প্রচলন ছিল না। তখন অনেকে নানাভাবে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এই শিক্ষকদের অনেকেই প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করলেও পূর্বের প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিল করেননি। প্রতিষ্ঠান প্রধান, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক কর্মকর্তার যোগসাজশে নতুন-পুরাতন দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই বেতন উত্তোলন করছেন তারা।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে মাউশির উপপরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘সহকারী শিক্ষক, প্রভাষকসহ অনেক সিনিয়র শিক্ষকও দুই প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন নিচ্ছেন। এ শিক্ষকদের কারণে প্রতি বছর সরকারের প্রায় শত কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। যে অর্থ দিয়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা যেত। এমনকি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যেত।’
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ‘খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে দ্বৈত এমপিও থাকা শিক্ষকদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে। এরপর তাদের বেতন-ভাতা বন্ধসহ পূর্বে গ্রহণ করা বেতন-ভাতা সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে। যারা রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করারও সুপারিশ করা হবে।’
জানুয়ারিতে ইএফটিতে বেতন-ভাতা দেওয়ার চিন্তা
বেসরকারি এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের ডিসেম্বর মাসের বেতন ইএফটির মাধ্যমে দিতে কাজ করছে মাউশি। এ জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে আইবাস ++এর কাছে অনুরোধ করা হবে বলে জানা গেছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর জানায়, যেসব প্রতিষ্ঠানে (স্কুল ও কলেজ) এমপিওভুক্ত জনবল রয়েছে তাদের এমপিও অর্থ আইবাস ++এর মাধ্যমে ইএফটিতে পাঠানোর জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের তথ্য দিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল গত ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের তথ্য দেয়নি। যেসব প্রতিষ্ঠান বরখাস্ত জনবল, প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত অনুপস্থিত জনবল বা আগে দেওয়া পাঁচটি অপশনের মধ্যে কোনও অপশনের সঙ্গেই সামঞ্জস্য নয়, এমন জনবলের তথ্য দেওয়ার জন্য নতুন একটি অপশন ‘স্থগিত/সাময়িক স্থগিত’ সংযোজন করা হয়েছে। অন্য পাঁচটি অপশন হচ্ছে—কর্মরত, মৃত, পদত্যাগকৃত, অস্তিত্ব নেই বা জাতীয়করণকৃত। এসব বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই এমন জনবলের তথ্য সংযোজনে অপশন যুক্ত করা হয়েছে। তাই যেসব প্রতিষ্ঠান এখনও তথ্য দেয়নি তাদের বুধবারের (১১ ডিসেম্বর) মধ্যে তথ্য দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে মাউশির সহকারী পরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) মো. খালিদ হোসেন বলেন, ‘আগামী জানুয়ারি মাস থেকে ইএফটিতে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হবে। তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’